
গ্রাফিক্স: জনকণ্ঠ
ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পাহালগাম, হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এক সুন্দর পর্যটনকেন্দ্র। সেখানে ঘটে গেল এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। ২৬ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অধিকাংশই ছিলেন ভারতীয় পর্যটক। পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কেউ ম্যাগি খাচ্ছিলেন, কেউ ঘোড়ায় চড়ছিলেন। হঠাৎ করেই সব আনন্দ থেমে যায়। আততায়ীরা গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়। ফেলে রেখে যায় কান্না, মৃত্যু আর শোক।
এই ঘটনা শুধু কাশ্মীরের নয়। এই গল্প গাজার, মিয়ানমারের, মণিপুরের। এটি আমাদের মানবতার সংকটের গল্প।
গাজায় প্রতিদিন মানুষ মরছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ— কারও জীবন নিরাপদ নয়। চারদিকে বোমার শব্দ, ধ্বংসস্তূপ আর রক্ত। বিশ্ব চুপ থাকে। কেউ কেউ পক্ষ নেয়। কেউ শুধু দেখছে।
মণিপুরে সহিংসতা চলছেই। ঘরবাড়ি পুড়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। মানুষ নিজের দেশে নিজেই অসহায়।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা ভয়াবহ অবস্থায় আছে। তাদের ঘরছাড়া করা হয়েছে। ছোট ছোট শিশু নৌকায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। কেউ কেউ পথে মারা যাচ্ছে। তবুও বিশ্ব নীরব।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমরা বন্দি। তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। শিক্ষা শিবিরে পাঠানো হচ্ছে। এই অন্যায় নিয়েও বিশ্ব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমেরিকায় আজও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ পুলিশের হাতে মারা যায়। কিছুদিন উত্তেজনা থাকে, তারপর সব ভুলে যাওয়া হয়।
বাংলাদেশেও একই চিত্র। বিভাজন ক্রমেই বাড়ছে। রাজনীতি এখানে মানবতার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিপক্ষকে আওয়ামী লীগ অথবা ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে বিএনপি, জামায়াত বা তথাকথিত ছাত্র-জনতার নামে সহিংসতা চলছে। সংঘর্ষে পুড়ছে ঘর, মরছে মানুষ, আহত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। কখনো পুলিশ, কখনো বিরোধী কর্মী— কিন্তু সবাই মানুষ।
এইসব ঘটনার মধ্যে একটাই মিল— মানুষ মরছে। রক্ত ঝরছে। কিন্তু আমরা বিচার করি ধর্ম, জাতি আর রাজনৈতিক সুবিধা অনুযায়ী।
একজন মুসলমান মারা গেলে কিছু মানুষ চুপ থাকে। একজন হিন্দু মারা গেলে অন্যরা চুপ থাকে। আমরা কাঁদি নিজের দলের মানুষের জন্য। অন্যদের মৃত্যু নিয়ে ভাবি না।
কিন্তু সব রক্তের রঙ এক— লাল। সব মায়ের কান্না একই রকম। সব শিশুর ভয় এক।
আমরা যদি সত্যিই মানুষ হই, তবে আমাদের কাঁদতে হবে প্রতিটি মৃত্যুর জন্য। শুধু নিজেদের পরিচয়ের জন্য নয়, মানবতার জন্য।
প্রতিশোধের ডাক আসছে। কেউ বলছে, যুদ্ধ হোক। কেউ বলছে, বোমা ফেলা হোক। কিন্তু সহিংসতা কখনো শান্তি আনতে পারে না।
যদি ভারত প্রতিশোধ নেয়, পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দেবে। তখন আবার মরবে সাধারণ মানুষ। শিশুরা, পর্যটকরা, স্বপ্ন দেখানো মানুষগুলো মরবে।
আমরা নিজেদের ভুলগুলোও দেখতে শিখি। কাশ্মীরি ছাত্ররা যদি পোস্ট করার জন্য জেলে যায়, তবে তা অন্যায়। ভারতীয় মুসলিম, দলিত, মণিপুরবাসী— তারা নিরাপত্তা চায়। আমরা তা দিতে পারছি না।
বাংলাদেশেও গণগ্রেপ্তার, গুম, রাজনৈতিক শত্রুতা ও প্রোপাগান্ডা চলেছে। কিন্তু কোনো পক্ষই পুরোপুরি নির্দোষ নয়। একদিকে ক্ষমতার দম্ভ, অন্যদিকে সহিংস প্রতিশোধ— এর মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সন্ত্রাস কখনো ন্যায় হতে পারে না। শিশু হত্যাকে কেউ সঠিক বলতে পারে না। গণগ্রেপ্তার বা গণহত্যা ন্যায়বিচার নয়।
আমরা আগে মানুষ হই। পরে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বা ইহুদি। শোকের ভাষা আলাদা নয়। কান্নার রঙ আলাদা নয়।
আমরা যদি শুধু নিজের দলের দুঃখ বুঝি, তাহলে মানবতা মরে যাবে। যদি আমরা পরিচয়কেই বড় করি, তাহলে কেউ জয়ী হবে না।
রক্তের রঙ লাল।
এই সত্যটাই আমাদের এক করতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.