ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

হজরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়েরের (রা.) আত্মত্যাগ

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

হজরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়েরের (রা.) আত্মত্যাগ

হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের (রা.) রাসুলুল্লাহ্র (সা.) ইবাদত গুজার সাহাবাদের মধ্যে একজন। তিনি খলিফা আবু বকরের (রা.) কন্যা আসমার (রা.) সন্তান। ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য দৃঢ়চেতা মহীয়ষী নারী আসমা বিনতে আবু বকর (রা.)। আদর্শের মূর্ত প্রতীক এ সংগ্রামী নারীর জীবন কথা ইতিহাস বড় গৌরবের সঙ্গে ধরে রেখেছে। তিনি ছিলেন মহান খলিফা আবু বকরের কন্যা, বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী যুবায়েরার বিন আওয়ামের (রা.) স্ত্রী, শহীদ আবদুল্লাহ বিন যুবায়েরের গর্বিত মা, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইমান গ্রহণকারিণী। এছাড়া মদিনা হিজরতের সময় সাউর উপত্যকায় চুপিসারে যারা আঁ-হযরতের সাহায্য সহযোগিতায় নিবেদিত ছিলেন, তাদের একজন। অপরদিকে মহানবীর (সা.) প্রিয়তম প্রথমা স্ত্রী খাদিজারও (রা.) ভ্রাতুষ্পুত্র ঘরের নাতি।
তার জম্মের পর রাসুল (সা.) সর্বপ্রথম নিজ পবিত্র মুখে খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিয়েছিলেন। আজীবন নূর নবীর (সা.) সুন্নাহ বা আদর্শ অনুসরণে তিনি ছিলেন অবিচল দৃঢ়চেতা। হজরতের (সা.) ওফাতের পর তিনি কিছু হাদীসও বর্ণনা করেছেন। হিজরি ৬৪ সালে উমাইয়া দুঃশাসন হতে মুক্তির জন্য হিজাজ, ইয়েমেন, ইরাক, খোরাসান ও সিরিয়াসহ কিছু অঞ্চলের মুসলমানদের একটি অংশ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ সময়ে তিনি পবিত্র খানায়ে কাবাকে হজরত ইব্রাহীম নবীর (আ.) যথাযথ ভিত্তির ওপর পুনঃসংস্কার করেন। এদিকে তারা খিলাফত ধ্বংসের জন্য উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক কুখ্যাত গভর্নর হাজ্জাজকে নির্দেশ দেন। হিজরি ৭২ সালে (খ্রিস্টাব্দ ৬৯২) ১৭ জমাদিউল আউয়াল ইতিহাসের এই মাসে এক অসম যুদ্ধে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের ও তাঁর সঙ্গী সাথীগণ (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। গোটা মুসলিম উম্মাহ তাদের এ আত্মদানকে এক বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের শাহাদাতের ঘটনা ছিল ইতিহাসের জালিম শাসকগোষ্ঠীর এক নিষ্ঠুরতম দৃষ্টান্ত। শাহাদাতের আগ মুহূর্তে তিনি জনম দুঃখিনী মার সঙ্গে অন্তিম সাক্ষাতে যান।
সত্য ও ন্যায়ের জন্য অবিচল থেকে জীবন উৎসর্গের জন্য দুজনের কথোপকথনে অভাবনীয় দৃঢ় মনোবল প্রকাশ পায়। ইতিহাসে যা অতি হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষাপ্রদ বলে বিবেচিত। সহীহ মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ডে বিষয়টি বিস্তারিত এসেছে। তিনি তার শেষ মুহূর্তের অনুসারীদের নিয়ে কাবার হারাম শরীফে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে উমাইয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘর্ষের কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি তাঁর মা আসমার সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাৎ করতে যান। হজরত আসমা (রা.) তখন বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত ও অন্ধ। মাতা-পুত্রের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি ছিল নিম্নরূপ-
আবদুল্লাহ- মা! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহহি ওয়া বারাকাতুহু।
হজরত আসমা (রা.)- আবদুল্লাহ! ওয়া আলাইকুমুস সালাম, হাজ্জাজ বাহিনীর মিনজানিক হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার সেনাবাহিনীর ওপর পাথর নিক্ষেপ করছে। মক্কার বাড়ি ঘর প্রকম্পিত করে তুলছে। এমন চরম মুহূর্তে তোমার উপস্থিতি কি উদ্দেশ্যে?
আবদুল্লাহ- উদ্দেশ্য মা, আপনার সঙ্গে কিছু পরামর্শ।
হজরত আসমা (রা.)- কি বিষয়ে পরামর্শ ?
আবদুল্লাহ- হাজ্জাজের ভয়ে বা তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে লোকেরা আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে গেছে, এখন আমার সঙ্গে অল্প লোক আছে। তাদের ধৈর্য ও সাহসিকতা যতই বেশি হোক না কেন, দু’এক ঘণ্টার বেশি তারা কোনো মতেই টিকে থাকতে পারবে না। এদিকে উমাইয়ারা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানকে খলিফা বলে স্বীকার করে নেই এবং অস্ত্র ফেলে দিয়ে তার হাতে বাইয়াত হই, তাহলে পার্থিব সুখ-সম্পদের যা আমি চাইব তাই তারা দেবে- এমতাবস্থায় আপনি আমাকে কি পরামর্শ দেন।
হজরত আসমা (রা.)- একটু উচ্চস্বরে বললেন, বিষয়টি তোমার একান্তই নিজস্ব। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বেশি জান। যদি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, তুমি হকের ওপর আছ এবং মানুষকে হকের দিকে আহ্বান করছ, তাহলে তোমার পতাকাতলে যারা অটল থেকে শাহাদাতবরণ করছে, তাদের মতো তুমিও অটল থাক। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে তুমি দুনিয়ার একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার লোকদের ধ্বংস করছ।
আবদুল্লাহ-  তাহলে আজ আমি নিশ্চিতভাবে নিহত হব।
হজরত আসমা (রা.)- স্বেচ্ছায় হাজ্জাজের কাছে আত্মসমপর্ণ করবে এবং বনী উমাইয়াদের ছোকরারা তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলা করবে, তা থেকে যুদ্ধ করে নিহত হওয়া উত্তম।
আবদুল্লাহ- আমি নিহত হতে ভয় পাচ্ছি না মা। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমার হাত-পা কেটে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে।
হজরত আসমা (রা.)- নিহত হওয়ার পর মানুষের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, জবেহ করা ছাগলের চামড়া তোলার সময় সে কি কষ্ট পায়?
একথা শুনে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের মুখমণ্ডলের দীপ্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তিনি (আবদুল্লাহ) বললেন, ‘আমার কল্যাণময়ী মা, আপনার সুমহান মর্যাদা আরও কল্যাণময় হোক। এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার মুখ থেকে কেবল মাত্র এ কথাগুলো শোনার জন্য আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছিলাম। আল্লাহ জানেন, আমি ভিত হইনি, আমি দুর্বল হইনি। তিনিই সাক্ষী, আমি যেজন্য সংগ্রাম করছি তা কোনো জাগতিক সুখ-সম্পদ ও মর্যাদার প্রতি লোভ-লালসা ও ভালোবাসার কারণ নয়। বরং এ সংগ্রাম হারামকে হালাল ঘোষণা করার প্রতি আমার ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণেই। আপনি যা পছন্দ করেছেন, আমি এখন সে কাজেই যাচ্ছি। আমি শহীদ হলে আমার জন্য কোনো দুঃখ করবেন না এবং আপনার সবই আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবেন।
হজরত আসমা (রা.)- যদি তুমি অসত্য ও অন্যায়ের ওপর নিহত হও, তাহলে আমি ব্যথিত হব।
লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

প্যানেল

×