
২০২৪ সালে বাংলাদেশের এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের কথা ছিল। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এ প্রক্রিয়াটি ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। অনেক বিতর্ক ও আশঙ্কা-উদ্বেগ থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ২০২৬ সালে এলডিসি-উত্তরণ প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে না দিয়ে চলমান রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৪ সালের পরের দুই বছরের অতিরিক্ত সময় বাংলাদেশেকে এলডিসি পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যেসব প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ছিল, তার অনেকটাই করা যায়নি। এমন এক অবস্থায় বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর ২০২৬ সালে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট-এফটিএ) করতে সম্মত হয়েছে। যা বাংলাদেশের ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পথে একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক মাইলফলক হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এলডিসি পরবর্তী যুগে নিজেদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে অনুকূল বাণিজ্য চুক্তি সুরক্ষিত করা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য। এই বিবেচনায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ সিঙ্গাপুর, অন্যদিকে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে যাত্রা। এমন এক প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে চলমান আলোচনা প্রকৃত অর্থেই বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। যা এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এরপর ৫৩ বছর ধরে উষ্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন, লজিস্টিকস এবং নৌ-বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী। বিদ্যমান শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে আরও গভীর অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ এবং বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সিঙ্গাপুরের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরে ১৪ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে সিঙ্গাপুর থেকে ২২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে সিঙ্গাপুরে ১২ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে আমদানি করেছে ৪১১ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের পণ্য। দুদেশের বিশাল এ বাণিজ্য ঘাটতির অর্থ হলো, বাংলাদেশের জন্য সিঙ্গাপুরে রপ্তানি বৃদ্ধির একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলো হচ্ছে তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, প্রকৌশল পণ্য এবং হোম টেক্সটাইল। আর সিঙ্গাপুর থেকে মূলত খনিজ পণ্য, মেশিনারি সামগ্রী এবং কেমিক্যাল পণ্য আমদানি করা হয়। এ বাণিজ্য কাঠামোর পরিপূরক শুল্ক হ্রাস এবং বাজার সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে উভয় দেশের জন্যই পারস্পরিক সুবিধার সম্ভাবনা তৈরি করে। সিঙ্গাপুরের উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের শিল্পে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। তেমনি বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের তৈরি পোশাক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিতে পারে সিঙ্গাপুরের বাজারে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পরে বাংলাদেশ অনেক ধরনের বাণিজ্য সুবিধা হারাতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মের অধীনে বিশেষ ও ভিন্নতর আচরণ এবং স্বল্প সুদে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত থেকে আসে এবং এলডিসি মর্যাদা হারানোর পরে এ খাতটি প্রধান বাজারগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ১২ শতাংশ বা তার বেশি শুল্কের সম্মুখীন হতে পারে। যা রপ্তানি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। যদিও ইইউ ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) উদ্যোগের অধীনে এলডিসি বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে, তবে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাজারে এই সুবিধা শীঘ্রই বন্ধ হতে পারে এবং স্ট্যান্ডার্ড শুল্ক প্রযোজ্য হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রস্তাবিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বাংলাদেশের জন্য এলডিসি-পরবর্তী বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ যখন অন্যান্য প্রধান বাজারে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা হারাবে, তখন সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) পূর্ব এশীয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাজার সুবিধা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বৃহত্তর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। যা বাংলাদেশের জন্য নতুন রপ্তানির সুযোগ উন্মোচন করবে। সিঙ্গাপুরের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংযোগ এই গতিশীল বাজারগুলোতে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকারকে আরও সহজ করতে পারে। এফটিএর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ, জ্বালানি, অর্থনৈতিক অঞ্চল, কৃষিপ্রযুক্তি এবং পর্যটন অবকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে সিঙ্গাপুরের বর্ধিত বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক ও উদ্ভাবনী কেন্দ্র হিসেবে সিঙ্গাপুরের খ্যাতি বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় মূলধন এবং উন্নত প্রযুক্তি জ্ঞান সরবরাহ করতে পারে। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বাংলাদেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বিশেষত ডিজিটাল অর্থনীতি এবং টেকসই জ্বালানির মতো ক্ষেত্রগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাংলাদেশের শিল্পগুলোকে আধুনিকীকরণ এবং তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। তবে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানির ওপর শুল্ক বিলোপের কারণে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে কিছু রাজস্ব হারাতে পারে, যার পরিমাণ হতে পারে প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আশা করা যায়, শুল্ক হ্রাস এবং বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি শিল্প উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি হবে, তা এই স্বল্পমেয়াদে রাজস্ব ক্ষতিকে অনেকাংশে পুষিয়ে দেবে। স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব ক্ষতি এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লাভের মধ্যে এই ভারসাম্য রক্ষা করা যে কোনো এফটিএ আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই রাজস্ব সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই কৌশলগতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, সম্ভবত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের পদ্ধতি উন্নত করার মাধ্যমে।
তবে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর এফটিএ আলোচনা এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ এবং বিবেচ্য বিষয়ও রয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বেশকিছু দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ শিল্পের স্বার্থ রক্ষা এবং রাজস্ব ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশে কিছু বিরোধিতা দেখা যেতে পারে। এফটিএর আওতায় পণ্যের বাণিজ্য ছাড়াও পরিষেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব অধিকার এবং সরকারি ক্রয়ের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা একটি জটিল প্রক্রিয়া হতে পারে। সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের সঙ্গে এফটিএ আলোচনা করার সময় বাংলাদেশকে নিজেদের দুর্বলতা এবং সক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। বাংলাদেশকে এমন একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে, যা কেবল তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করবে না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পের বিকাশেও সাহায্য করবে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। তবে এটি বেশকিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসবে। এই প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রস্তাবিত এফটিএ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ঐতিহাসিকভাবে সর্বাপেক্ষা উন্নত মুক্তবাজার অর্থনীতির ফসলরূপে গড়ে উঠেছে। বিশ্বে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে সিঙ্গাপুর তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানীয়। মোট দেশজ উৎপাদনের হার ১৪.২ শতাংশ। দেশটির অর্থনীতি সর্বাপেক্ষা মুক্ত, সংস্কারবাদী, প্রতিযোগিতামূলক, গতিশীল ও ব্যবসাবান্ধব। দুদেশের এফটিএ চূড়ান্ত হলে তা কেবল বাংলাদেশের জন্য পূর্ব এশিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করবে না, বরং সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগও বৃদ্ধি করবে। যদিও এই চুক্তির ফলে কিছু স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি হবে। অন্যান্য এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ দেশের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একটি সুচিন্তিত এবং ব্যাপক এফটিএ বাংলাদেশের এলডিসি-পরবর্তী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে সহায়ক হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল