
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্র বলছে, কয়েক বছর ধরে হাওড়াঞ্চল দিয়ে পানি নামার গতি অনেক কমে গেছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের হাওড়াঞ্চলে অলওয়েদার সড়কের মতো অনেক সড়ক ও স্থাপনা গড়ে ওঠায় পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। হাওড়াঞ্চল তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এসব অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। তারা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। হাওড়াঞ্চলের ২৯ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বহুদিন থেকে হাওড়কে ঘিরে একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। প্রকৃত মাছ চাষিদের স্বার্থে হাওড়ে ইজারা প্রথা বন্ধ করা প্রয়োজন। হাওড়াঞ্চলে স্থানীয় জাতের ধানের পরিবর্তে আধুনিক চাষাবাদের ফলে আগের মতো পানি, মাছ আর ধান হচ্ছে না। আগে হাওড়ে স্থানীয় জাতের ধান চাষ হতো। এত কীটনাশক ও সার প্রয়োজন হতো না। এখন ওখানে করা হচ্ছে আধুনিক জাতের চাষ। আধুনিক জাতের চাষ করা মানে কীটনাশক, রাসায়নিক সার দেওয়া। এগুলো প্রাণ-প্রকৃতির জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। ফলে, ধান চাষ বৃদ্ধি পেলেও দেশী জাতের মাছ উৎপাদন অনেক কমে গেছে। মাছের কোনো কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষায় দেশের কোনো হাওড়-বাঁওড় কারও কাছেই ইজারা দেওয়া উচিত নয়। হাওড়ের বিস্তৃৃত জমিন এবং বর্ষায় সুবিশাল জলাধার স্থানীয় মানুষের জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত উপহার। এগুলো সেখানকার নাগরিকদের অধিকার। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে কেউ যেন বাংলাদেশের প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষের অধিকার খর্ব করতে না পারে। এর জন্য প্রচলিত আইন সংস্কার করে কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। ইতোমধ্যে ইটনা-মিঠামইন সড়ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আগামীর বাংলাদেশে এমন প্রকৃতি বিনাশী সিদ্ধান্ত আর যেন কোনো ব্যক্তি কিংবা শাসকগোষ্ঠী নিতে না পারে, এমন পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। হাওড়াঞ্চলকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনাও প্রয়োজন। ইজারা প্রথা বাতিল করে দেশের জলমহালগুলোর একটা হালনাগাদ তথ্য তৈরি করা বাঞ্ছনীয়।
হাওড় থেকে ইতোমধ্যে নানা প্রজাতির বর্ণিল মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। প্রকৃতির এ মৎস্য ভাণ্ডার সুরক্ষায়, হাওড়ে জলাবন রক্ষা করতে হবে। হিজল-করচা গাছের পাতায় যে অনুজীব তৈরি হয়, তা মাছের খাবার। হাওড়ের প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় হাওড়কে যৌথ নদী কমিশনের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ হাওড় উন্নয়ন বোর্ড’। তবে ১৯৮২ সালে সরকারের এক আদেশে তা বিলুপ্ত হয়। এর প্রায় দুই দশক পর ২০০০ সালে আবার গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’। রাষ্ট্রের এ প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে হবে, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে। হাওড়ে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারত মেঘালয় রাজ্যের গহিন বন কেটে বড় বড় বাঁধ নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত খনি তৈরি করেছে। উজানের এসব কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশেরও পরিবেশ-প্রকৃতি ও হাওড়াঞ্চলের জীববৈচিত্র্য প্রায় ধ্বংসের পথে।
প্যানেল