
ছবি: প্রতীকী
এক সময় মানুষের স্বপ্ন ছিল— একটা এমন পৃথিবী, যেখানে যুদ্ধের ইতিহাস শুধুই পাঠ্যবইয়ে থাকবে, মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, হাতে হাত রেখে চলবে বিশ্বসভ্যতা। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ যেন ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তি ও প্রগতির আড়ালে লুকিয়ে আছে যুদ্ধ, দখল, হাহাকার আর রাজনৈতিক স্বার্থে পিষ্ট হওয়া কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কান্না।
ফিলিস্তিনে গাজার বুকে প্রতিদিনের রক্তপাত যেন এক নির্মম উপাখ্যান। শিশুর কান্না আর বোমার শব্দ মিশে গেছে একসাথে, যেখানে মানবিকতা থেমে গেছে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের কাছে। ইসরায়েলের লাগাতার সামরিক হামলা এখন আর কেবল নিরাপত্তার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা পরিণত হয়েছে নিছক দখলের খেলার এক ভয়াবহ প্রতীক হিসেবে। বিশ্বশক্তিগুলোর ভূমিকা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে। মিডিয়ায় ভেসে আসা নিহত শিশুদের ছবি বা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা পরিবারের গল্পগুলো হয়তো মুহূর্তের জন্য নড়ে দেয় বিবেক, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা চাপা পড়ে যায় কূটনৈতিক স্বার্থ আর শক্তির খেলায়।
ইয়েমেনে বছরের পর বছর ধরে চলা সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানে ধ্বংস হয়ে গেছে গোটা দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার অভিযোগও সেখানে নতুন নয়। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের শিকার এই দেশটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি আন্তর্জাতিক মহলকে। দরিদ্র দেশটিতে হাজার হাজার শিশু আজও না খেয়ে ঘুমায়, আতঙ্কে কাটায় প্রতিটি মুহূর্ত। এছাড়া ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়ে ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধাদের লড়াই দমাতে দেশটিতে আমেরিকা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনার আগুন জ্বলছে দীর্ঘদিন ধরে। ইরান ও আমেরিকার মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলা বৈরিতা আবারও তীব্র হয়ে উঠছে। নিষেধাজ্ঞা, সামরিক চাপ, সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে চাপিয়ে দেওয়া প্রতিকূলতা— সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চলটাই এক অনিশ্চয়তা ও বিস্ফোরণের প্রান্তে দাঁড়িয়ে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এটি আর কেবল দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে গেছে ইউরোপ, আমেরিকা ও ন্যাটোর মতো সামরিক জোট। যুদ্ধের ভয়াবহতায় ধ্বংস হচ্ছে শহর, হারাচ্ছে প্রাণ, অথচ সমাধানের পথ এখনও অন্ধকার।
দক্ষিণ এশিয়ার ছবিটাও কম উদ্বেগজনক নয়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় বৈষম্য ও চরমপন্থার উত্থান গোটা অঞ্চলকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। কাশ্মীর সংকট এই উত্তেজনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এই ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতির পরিবর্তনের পর আরও জটিল হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব পড়েছে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং সাধারণ মানুষের জীবনে।
অন্যদিকে মায়ানমারে সামরিক জান্তার দমন-পীড়নে সাধারণ মানুষ অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর চালানো হামলা, রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনের প্রেক্ষাপট মায়ানমারকে পরিণত করেছে এক আন্তর্জাতিক মানবিক সংকটের কেন্দ্রস্থলে। প্রায় বিশ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বিশ্ব রাজনীতির অন্য প্রান্তে চীন ও আমেরিকার মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ এখন অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রতিটি খাতে ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থেকে সামরিক প্রস্তুতি—সবকিছুই এখন ইঙ্গিত করছে এক নতুন বৈশ্বিক দ্বন্দ্বের দিকে, যেখানে প্রতিটি দেশকেই নিজের অবস্থান নির্ধারণ করতে হচ্ছে।
সিরিয়ায় দীর্ঘ এক দশকের গৃহযুদ্ধ, আইএস-এর উত্থান, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ—সব মিলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এক সময়ের সমৃদ্ধ সভ্যতা। লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্য দেশে, কেউ আশ্রয় পেয়েছে, কেউ হারিয়ে গেছে সাগরের ঢেউয়ে।
ইরাকের চিত্রও তেমনই ভয়াবহ। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বিভীষিকায়। লিবিয়ায় গণতন্ত্রের আশায় গাদ্দাফিকে সরিয়ে দিয়ে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে গৃহযুদ্ধ ও প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির লড়াইয়ে।
লেবাননের অর্থনৈতিক পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েন এখন দেশটিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। তুরস্কের ভূমিকাও মধ্যপ্রাচ্যে নানা মাত্রিক— সিরিয়া সংকটে সরাসরি জড়িত থাকার পাশাপাশি নিজ দেশের ভেতরেও চলছে গণতান্ত্রিক সংকোচন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ।
এই পুরো প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য যেন এক রক্তাক্ত মানচিত্র—যেখানে প্রতি ইঞ্চি জমি হয়ে উঠেছে শক্তির লড়াইয়ের মঞ্চ। জ্বালানি সম্পদ, ভৌগোলিক আধিপত্য আর ইতিহাসের ঔপনিবেশিক বিভাজন এই অঞ্চলের শান্তিকে করেছে দুর্লভ এক কল্পনা।
তাইওয়ানকে ঘিরে চীন ও আমেরিকার বিপরীতমুখী লড়াই, কোরীয় উপদ্বীপে অস্থিরতা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে।
এতসব বাস্তবতার মুখে প্রশ্ন উঠে আসে— শান্তি কোথায়? কীভাবে ফিরে আসবে সেই সাম্যের পৃথিবী, যেখানে মানুষ কেবল বন্ধু হয়ে দাঁড়াবে মানুষের পাশে, শত্রু নয়।
উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের চাই এক নতুন মানসিকতা, যেখানে মানবতা হবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে, আর শান্তি হবে আপোষ নয়, সাহসিকতার প্রতীক। যতদিন না আমরা যুদ্ধকে হার স্বীকারের ভাষা আর শান্তিকে শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে দেখতে শিখবো, ততদিন এই ধ্বংসযজ্ঞ চলতেই থাকবে।
এই বিভক্ত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে সেই শিশুরা— যাদের শৈশব কেটেছে বাঙ্কারে, শরণকেন্দ্রে বা ধ্বংসস্তূপে। তাদের চোখে প্রশ্ন— এই পৃথিবী কি কেবল শক্তিধরদের জন্য? না কি একদিন ফিরে আসবে এমন এক সকাল, যেখানে কাঁদবে না কোনো শিশু, আর যুদ্ধের বদলে শোনা যাবে শান্তির গান?
লেখক: সাংবাদিক ([email protected])
এম.কে.