ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান একই সূত্রে গাঁথা

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ২০:০৫, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান একই সূত্রে গাঁথা

সম্প্রতি সামষ্টিক অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকট, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা ও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। অন্যদিকে, প্রতিবছর ২০-২৫ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। তাদের বড় একটি অংশ কাজ না পেয়ে বেকার থাকছেন। বিবিএসের ২০২৪ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী গত বছরের শুরুতে বেকার মানুষের সংখ্যা কম থাকলেও বছরের শেষে তা বেড়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এক লাখ ৭০ হাজার বেকার বেড়ে বছরের শেষে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন সময়ে প্রণীত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থানের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা কখনোই অর্জিত হয়নি। মূলত কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতি, পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ধীরগতি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব, অভিবাসনের জন্য নতুন উৎস খুঁজে বের না করা, দুর্নীতি, মানসম্মত শিক্ষার ঘাটতি, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অভাব ইত্যাদি এর জন্য দায়ী। এমতাবস্থায়, এসএমই খাতে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনয়ন, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম জোরদারকরণ, মানসম্মত শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সম্পদের সহজলভ্যতা, আত্মকর্মসংস্থানমুখী কর্মকাণ্ড জোরদার, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
সম্প্রতি আইএলওর পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক এক পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছে, বিগত এক দশকে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেড় শতাংশ হারে বাড়লেও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারের সংখ্যা বাড়ছেই। অন্যদিকে বেশিরভাগ কর্মক্ষম মানুষ তাদের শ্রমশক্তি পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছেন না। যাকে এক কথায় প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব বা আংশিক বেকারত্ব বলা হয়। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যথাক্রমে ১৬ শতাংশ ও ৮৪ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ নিয়োজিত আছেন। নির্মম হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের সকল কর্মক্ষম মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সরকারকে অধিকসংখ্যক উদ্যোক্তা তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বিগত ৫৩ বছরে দেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কৃষিনির্ভরতা কাটিয়ে শিল্পের দিকে দেশ এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান কৃষিকে ছাড়িয়ে গেলেও শ্রমবাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কৃষির আধুনিকায়ন, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এক্ষেত্রে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। যা কর্মসংস্থানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এটা সত্য যে, বিগত সাড়ে আট মাসে নানা কারণে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার কর্মী কর্মচ্যুত হয়েছেন। বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বেকারত্ব একটি বড় সংকট হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সংবাদে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতি, হানাহানির ঘটনা বাড়ছে, যার বড় কারণ বেকারত্ব। বেকারত্ব দূর করতে হলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান আবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, সম্পদের সহজলভ্যতা, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে ৪৫০ জন বিদেশী বিনিয়োগকারী অংশ নেন। এই সময়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে বাটা, কেএফসি, পিজা হাটসহ অনেক দোকান ও শোরুম ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। সম্মেলনে আগত বিনিয়োগকারীদের প্রধান উদ্বেগ ছিল ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে। তারা বলেছেন, নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা, স্বয়ংক্রিয় মুনাফা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থার অভাব, দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি, ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিট সংক্রান্ত জটিলতা বাধা সৃষ্টি করে বিনিয়োগে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, বিনিয়োগের বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করে সরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করবে। সম্মেলনের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ‘বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নয়, বরং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।’ কেউ কেউ আশা প্রকাশ করেছেন, অচিরেই বাংলাদেশ বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে এবং কর্মসংস্থানের জোয়ার বইবে। তবে সমালোচকরা মনে করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও অনেক কিছু অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করছে, যার ফল হতে পারে উল্টো।
সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা এখনো ক্ষীণ। ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। যেখানে বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধিকাংশ এলাকাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকার, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, আরাকান আর্মি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন।
সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি হলেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানির সুবিধা বাতিলÑ এ সিদ্ধান্তগুলো তৈরি পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যার ফলে, কর্মসংস্থানও হুমকির মুখে পড়বে। তাই কৌশলগত বিষয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে বিবেচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সমীচীন। ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ‘সুনীল অর্থনীতি’ কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে পারে এবং একটি আঞ্চলিক বন্দর-হাব হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোটারডাম, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো বন্দরগুলো অনুকরণীয় হতে পারে।
দীর্ঘ সাড়ে আট মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নয়ন না হওয়ায় জনগণ উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি মব ভায়োলেন্সের ধারাবাহিক ঘটনাও আশঙ্কাজনক। ব্যক্তিগত স্বার্থে কিংবা মতবিরোধকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারের তকমা দিয়ে ফায়দা নেওয়ার প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বর্তমানে সরকারের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক, যদিও তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, তাই এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি বিকল্প বাজার খুঁজে বের করাও জরুরি। ভারতের সঙ্গে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ধারা ব্যাহত করছে। তাই বিনিয়োগের ধারাকে মুক্ত ও গতিশীল রাখতে নীতির ধারাবাহিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, সম্পদের সহজলভ্যতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এই উপলব্ধিটুকু যত দ্রুত অর্জিত হবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য হবে মঙ্গলজনক।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×