ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক

সাদিয়া সুলতানা রিমি

প্রকাশিত: ১৬:৫০, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক

দক্ষিণ এশিয়া, যা ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে অগণিত সংকটের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে ইসলামাবাদ-দিল্লি-ঢাকা ত্রিভুজের রাজনৈতিক গতিশীলতা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিন দেশের সম্পর্ক শুধু দ্বিপক্ষীয় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত।
ইসলামাবাদ-দিল্লি: ভারত-পাক সম্পর্ক: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাস দারুণ জটিল। যেখানে সামরিক সংঘাত, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও সীমান্ত উত্তেজনা একে-অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২০২১ সালে কাশ্মীর সীমান্তে আংশিক শান্তি ও হ্যান্ড-হোল্ডার বৈঠক পরিচালিত হলেও, ২০২৪ সালে আক্রমণাত্মক ঘটনার পর সম্পর্ক আবার উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর্থিক ও বাণিজ্যিক বিনিময় সীমিত হলেও, সাম্প্রতিক ‘জিও-অর্থনৈতিক’ ধারণা অনুযায়ী, দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব আসছে। এই প্রস্তাবে বলা হচ্ছে অস্ত্র-খাতের পরিবর্তে পরস্পর নির্ভরশীল অর্থনৈতিক খাতগুলো জোরদার করে দ্বিপক্ষীয় সংকট হ্রাস করা যেতে পারে।
দিল্লি-ঢাকা: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ২০১০-এর দশকে নির্মাণ অর্থনীতি, বন্দর সংযোগ ও বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। ২০২৪ সালের অক্টোবরে তিনদেশীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষে নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ২০২৪-এর জুলাইয়ে ঢাকায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর খুবই অল্প সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা ম্লান হয়েছে। নির্বাচন আগেই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দিল্লির সংলাপ শুরু হলেও, নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা প্রশ্নোত্তর বজায় রয়েছে।
ঢাকা-ইসলামাবাদ: বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক : বাঙালি স্বাধীনতার ১৯৭১-এ ঘটে যাওয়া মারাত্মক ইতিহাসের স্মৃতি এখনো দুই দেশের সম্পর্কের অন্তর্নিহিত ব্যাধি। ২০১০ সাল পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বন্ধ থাকলেও চলতি মাসেই ১৫ বছরের বিরতির পর পুনরায় বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকে বৈষয়িক ও সামরিক সমন্বয় ছাড়াও ইতিহাস পুনরুদ্ধার এবং যুদ্ধাপরাধ অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলাপ হয়েছে।
ত্রিপক্ষীয় ক্ষেত্র-সহযোগিতা ও আঞ্চলিক সংগঠন:
ঝঅঅজঈ (ঝড়ঁঃয অংরধহ অংংড়পরধঃরড়হ ভড়ৎ জবমরড়হধষ ঈড়ড়ঢ়বৎধঃরড়হ) ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও সুদক্ষ কার্যক্রমের অভাবে প্রায় স্থবির অবস্থায় পড়েছে। নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক আস্থায় স্বল্পতার কারণে সারা বছর ধরে শৃঙ্খলাবদ্ধ বৈঠক হয় না। ইওগঝঞঊঈ (ইধু ড়ভ ইবহমধষ ওহরঃরধঃরাব ভড়ৎ গঁষঃর-ঝবপঃড়ৎধষ ঞবপযহরপধষ ধহফ ঊপড়হড়সরপ ঈড়ড়ঢ়বৎধঃরড়হ) দক্ষিণ ও দক্ষিণ-প্রশান্ত অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধনের একটি পরিবেশ তৈরি করেছে। সাত সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য, শক্তি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সমন্বয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় ২০২৪ সালের মন্ত্রিসভা বৈঠকে পরিবহন, যোগাযোগ, শক্তি ও প্রযুক্তি সেক্টরে কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। ইধহমষধফবংয-ইযঁঃধহ-ওহফরধ-ঘবঢ়ধষ (ইইওঘ) সক্রিয় থাকলেও, ভূরাজনৈতিক কারণে কার্যকর বাস্তবায়ন দেরি করছে। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা হচ্ছে ঢাকায়। কিন্তু সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নথি যাচাই নিয়ে দ্বিধা রয়েই যাচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য আঞ্চলিক উদ্যোগেও তিন দেশের সমন্বয় পর্যাপ্ত নয়।
চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (ইজও) ও মার্কিন সংযোগ বৃদ্ধি এই অঞ্চলে শক্তি ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে। পাকিস্তানের গ্বাদার তীব্র চীনা বিনিয়োগ এবং মার্কিন-ভারতীয় প্রতিরক্ষা ঘনিষ্ঠতা, দুইপক্ষের জন্যই চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ‘স্তর-দ্বিমুখী’ নীতি অনুসরণ করে চীনা ও ভারতীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। ত্রিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বড় বাধা হলো সীমান্ত অবকাঠামো ও কাস্টমস প্রক্রিয়ার জটিলতা। এতে সরকারি উদ্যোগ হিসাবে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ স্থাপনের প্রস্তাব আনা হয়েছে, যা কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দ্রুততর করবে। বাণিজ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকিং জোট গঠন এবং মুদ্রা বিনিময় নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের কথা ভাবা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা সীমান্ত পেরিয়ে সহজে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন।
কাশ্মীর সীমান্ত ও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের আশঙ্কা এখনো বিদ্যমান। যৌথ সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সীমান্তে মনিটরিং সিস্টেম উন্নত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ত্রিপক্ষীয় আকাশসীমা ব্যবহার, ড্রোন নজরদারি ও সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমন্বিত নীতি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা তোলা হয়েছে।
ঐতিহাসিক অভিযোগ, যুদ্ধাপরাধ মামলা এবং জনগণের মনস্তত্ত্ব এখনো বড় বাধা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনকালীন পরিবেশ এবং অভ্যন্তরীণ চাপও কার্যকর সংলাপ বাধাগ্রস্ত করে। ভৌগোলিক বিভাজন, ভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক চাহিদা এবং শক্তি বিনিয়োগের টানাপোড়েন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগকে আরম্ভ করলেও, তাতে স্থায়িত্ব আসা কঠিন।
যদি ২০২৫ সালের মধ্যভাগে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা কার্যকর হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। একই সঙ্গে ঢাকা-ইসলামাবাদ সংলাপ সফল হলে ট্রেড রুট পুনরুদ্ধার সম্ভব। ত্রিপক্ষীয় আঞ্চলিক ফোরামগুলো (ইওগঝঞঊঈ, ইইওঘ) সক্রিয়করণে ঢাকার নেতৃত্ব এবং দিল্লির সহযোগিতা ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়াকে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগতভাবে আরও যুক্ত করতে পারবে।
ইসলামাবাদ, দিল্লি এবং ঢাকা- এই তিন কেন্দ্রে নতুন রাজনৈতিক মানচিত্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও, ঐতিহাসিক রেশ, নিরাপত্তাগত উদ্বেগ ও রাজনৈতিক চাপ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। দ্বিপক্ষীয় কাঠামো মজবুত হলে ত্রিপক্ষীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার দরজা খুলবে। যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×