ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

টরেন্টোর চিঠি

মার্ক কার্নি জাদুতে কুপোকাত পলিয়েভ

ড. শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২১:০০, ২২ এপ্রিল ২০২৫

মার্ক কার্নি জাদুতে কুপোকাত পলিয়েভ

মার্ক কার্নি ও পিয়েরে পলিয়েভ

গত ১৭ এপ্রিল কানাডার জাতীয় নির্বাচনের ইংরেজি ভাষায় চূড়ান্ত নেতাদের বিতর্ক অনুষ্ঠানটি দেখলাম। যদিও নিশ্চিত ছিলাম না পুরো অনুষ্ঠানটি দেখতে চাই কিনা, কিন্তু একবার দেখা শুরু করার পর কোনোমতেই পুরো বিতর্ক শেষ না করে উঠতে পারলাম না। অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গোছানো একটি বিতর্ক হয়েছে, যেখানে কানাডার মূল চারটি রাজনৈতিক দলের নেতা- লিবারেল নেতা মার্ক কার্নি, কনজার্ভেটিভ নেতা পিয়েরে পলিয়েভ, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নেতা জাগমিত সিং এবং ব্লক কেবেক নেতা ইভ ফ্রাঁসোয়া ব্লঁশে একসঙ্গে মুখোমুখি হয়েছিলেন।

বিতর্কের প্রথম অংশটি প্রধান কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করা ছিল- কানাডিয়ানদের জীবনযাপনে হুমকি ও শুল্কনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় ও ক্রয়ক্ষমতা, জননিরাপত্তা এবং সংকটকালে নেতৃত্বদান। প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত একটি সেগমেন্ট ছিল, যেখানে প্রথমে প্রত্যেক নেতা এক মিনিট করে বক্তব্য রাখেন। তারপর একে অপরকে প্রশ্ন করার সুযোগ পান। এ কাঠামোটি পাঁচটি সেগমেন্ট জুড়ে অনুসরণ করা হয়। এরপর বিতর্কটি চলে যায় দ্রুত প্রশ্নোত্তর পর্বে, পরস্পরের প্রতি প্রশ্ন, নির্দিষ্ট নেতাকে প্রশ্ন এবং শেষে সমাপ্তি বক্তব্য।

বিতর্কটি বেশ উপভোগ করেছি, যদিও আমার মনে হয়নি কেউ সুস্পষ্টভাবে জয়ী হয়েছেন। অধিকাংশ বক্তব্য আগেও বহুবার শোনা হয়েছে এবং কেউই এমন কোনো চমকপ্রদ মন্তব্য দেননি, যা পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। প্রথম দুটি সেগমেন্টে আমি মনে করি মার্ক কার্নি বাকিদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। বিশেষত, ট্রাম্প আমলের আমদানি শুল্ক হুমকি সম্পর্কে তার সতর্ক এবং বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ভালো লেগেছে। তিনি বলেন, আমেরিকার অর্থনীতি কানাডার চেয়ে দশ গুণ বড়। তাই ‘এক টাকার বদলে এক টাকার শুল্কারোপ’ কৌশল আমাদের ক্ষতিই বাড়াবে। বরং খাতভিত্তিক শুল্কনীতির যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন, সেটি বেশি বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। 
জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে আলোচনায় বেশির ভাগ নেতার বক্তব্য ছিল মোটামুটি। জাগমিত সিং এখানে অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন- নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে সহায়তা এবং কানাডার কল্যাণনীতিকে ধরে রাখার বিষয়ে। অন্যদের বক্তব্যে খুব একটা নতুনত্ব ছিল না। জননিরাপত্তা, অপরাধ দমন, শক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে পিয়েরে পলিয়েভ তুলনামূলকভাবে বেশি বলিষ্ঠ ছিলেন। কার্নি এবং সিং যেখানে সাধারণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; যেমনটা জাস্টিন ট্রুডোও দিয়েছেন আগে, পলিয়েভ তার বাইরে গিয়ে অপরাধীদের জবাবদিহির কথা বলেন।

তিনি বলেন, ভয়ংকর সব অপরাধী কিছুদিন পরেই ছাড়া পেয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে। যেটি নির্বাচিত হলে তার সরকার প্রতিরোধ করবে। তিনি বলেন, এটি অগ্রহণযোগ্য যে, একজন অপরাধী ৫ জন মানুষকে হত্যা করলেও গড়ে একেকজনের জন্য মাত্র ৪ বছর করে জেল খেটে ১৬ বছর পরেই জেল থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও এনার্জি সেক্টরে গত দশকে লিবারেল-এনডিপির ব্যর্থতার দায়ও তুলে ধরেন তিনি, যেটা ব্লক নেতা ব্লঁশেও খানিকটা সমর্থন করেন। তেল, শক্তি এবং আবাসন ইস্যুতে কার্নির অস্বস্তি ছিল চোখে পড়ার মতো।

হয়তো গত এক দশকে লিবারেল সরকারের অংশ হিসেবে এসব ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার কারণে তিনি প্রশ্নের উত্তরে অতটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। সংকটময় পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের বিষয়ে সব নেতার বক্তব্যই ছিল দুর্বল। ব্লঁশে তো কার্নির নেতৃত্বদান ক্ষমতার কঠোর সমালোচনাও করেন। তিনি বলেন, ব্রেক্সিট এবং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় কার্নির ভূমিকা ‘অতিরিক্তভাবে প্রশংসিত’ হয়েছে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় গাড়ি তৈরি এবং কাঠ প্রস্তুত খাতে তার বৈষম্যমূলক নীতি কেবেককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ব্লঁশে পুরো বিতর্কে একাধিকবার কার্নির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগও আনেন। তিনি বলেন, কার্নি কেবেকের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত স্বাধীনতাকে যথেষ্ট স্বাধিকার দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাননি।

জাগমিত সিংয়ের বক্তব্য ও তথ্যভিত্তিক উপস্থাপন তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও বিতর্কে তার আচরণ খারাপ লেগেছে। বিশেষ করে পলিয়েভের বক্তব্যের সময় তিনি বারবার বাধা দিয়েছেন। যে কারণে তাকে থামাতে সঞ্চালককে একাধিকবার হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। বিতর্ক অনুষ্ঠানের পর সিবিসি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে যোগ দিয়ে দর্শকরাও এ বিষয়ে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, এভাবে কথার মাঝে বাধা দেওয়া কানাডিয়ান ভব্যতার সঙ্গে যায় না। এমন একটি জাতীয় বিতর্কে প্রতিপক্ষকে সময় না দিয়ে টানা কথা বলা আমার কাছেও নেতিবাচকই মনে হয়েছে।

পুরো অনুষ্ঠানে পৃথিবীর অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী একটি দেশের প্রধান নেতারা যেভাবে সঞ্চালকের নির্দেশনা মতো সময় মেনে কথা বলছিলেন, তা মনোমুগ্ধকর লেগেছে। এমন নয় যে, আমি এ বিষয়টি আগে জানতাম না। কিন্তু যতবারই তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার নিদর্শনগুলো দেখি, ততবারই দেশের রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য প্রায় তিন দশক আগে সাবেক মেয়র ও উপস্থাপন আনিসুল হকের সঞ্চালনায় আমাদের দেশের নির্বাচনের আগে আগে বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের বিতর্কের কথা মনে হয়েছে।

তিন দশক আগেও আনিসুল হক মোটামুটি একটি মান বজায় রেখে এ ধরনের অনুষ্ঠান বাংলাদেশে করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন এমন একটি অনুষ্ঠান বাংলাদেশে আর করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। না আছে আমাদের নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, না আছে তাদের সঞ্চালনা করার মতো যোগ্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো সঞ্চালক। 
ব্লঁশে পুরো বিতর্কেই শুধু কেবেক নিয়ে কথা বলেছেন এবং কেবেক ও কানাডাকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবেই যেন উপস্থাপন করেছেন বারবার। যদিও কেবেকের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সবার সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, তবু জাতীয় বিতর্কে একটি প্রদেশকে আলাদা রাষ্ট্রের মতো উপস্থাপন করাটা অনুচিত বলেই মনে হয়েছে। কার্নি যেভাবে বলেছিলেন, ‘আমরা একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়তে চাই, তেরোটি আলাদা অর্থনীতি নয়’Ñ সেটি এ ধরনের প্রদেশকেন্দ্রিক মনোভাবের মুখে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

এটি পাঠকদের জানিয়ে রাখতে চাই যে, কানাডায় মোট ১৩টি প্রদেশ ও স্বতন্ত্র অঞ্চল আছে। আদিবাসী ও ফ্রেঞ্চভাষী প্রদেশগুলো তো বটেই, এমনকি বাকি প্রদেশগুলোও অনেকটা নিজেদের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা করে। ইমিগ্রেসন, স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক ক্ষেত্রেই সেসব বিষয়ে ফেডারেল বা জাতীয় সরকারের ভূমিকা থাকে নগণ্য। এটি আরও বিস্ময়কর যে, এই ১৩টি প্রদেশ একে অপরের ওপর শুল্কারোপ করে। অর্থাৎ, এদের নিজেদের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদান করার সময় আলাদা শুল্ক দিতে হয়।

যে কারণে কানাডায় জীবনযাত্রা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কার্নি তার বক্তব্যে বারবার বলেছেন যে, এই বৈষম্যের অবসান হওয়া উচিত এবং প্রদেশগুলোর একটি রাষ্ট্রের একক অর্থনীতি হিসেবে কাজ করা উচিত। এ বিষয়ে কিছু প্রদেশের আপত্তি আছে, বিশেষত কেবেক, যারা নিজেদের স্বতন্ত্রভাবে এনং কানাডা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চায়। কেবেক এবং আলবার্টার বিচ্ছিন্নতার কারণে কানাডায় এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে তেল নিতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে নিতে হয়।

কারণ, প্রদেশগুলোর মধ্যে তেল পরিবহনের কোনো চুক্তি নেই এবং পরিবহন করার মতো পাইপলাইনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এমনকি কার্নির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে যদি আগামীতেও পাইপলাইন তৈরি শুরু হয়, সেটির কাজ শেষ হতে দেড় যুগের বেশি লাগবে। কারণ, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কানাডা রাশিয়ার পর পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্র। 
এদিকে কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান পিয়েরে পলিয়েভ, যিনি নিজেকে আগামীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছিলেন, মোটামুটি সম্মানজনক আচরণ বজায় রেখেছেন। তবে খুব বেশি উদ্ভাবনী বা চমকপ্রদ কিছু বলেননি। কিছু জায়গায় তাকে অস্বস্তিতে পড়তেও দেখা গেছে। তার বক্তব্য বারবার শোনা পুরানো বক্তব্যের মতোই লাগছিল।

বিতর্কে বলা প্রায় সব কথাই তিনি আগেও সংসদে অসংখ্যবার বলেছেন। তবে তিনি জনগণের প্রতি সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করেছেন, যা অন্যরা নিজেদের মধ্যে বিতর্কে ব্যস্ত থাকায় করতে পারেননি। কিন্তু  আন্তর্জাতিক সংকট, বিশেষ করে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল হতাশাজনক। ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যার বিষয়টি তিনি উপেক্ষা করেছেন, যেখানে কার্নি এবং সিং হামাসকে নিন্দা জানালেও প্যালস্টাইনে মানবিক সহায়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান চেয়েছেন। ব্লঁশের বক্তব্য অস্পষ্ট ছিল, তবে অভিবাসন বিষয়ে তার কিছু মন্তব্য বর্ণবাদী ও মুসলিমবিরোধী মনে হয়েছে।
সব মিলিয়ে, মার্ক কার্নিই বিতর্কে এগিয়ে ছিলেন। তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। প্রতিপক্ষদের প্রতি সম্মান রেখেও দৃঢ়ভাবে নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। স্পষ্ট বলেছেন যে, তিনি জাস্টিন ট্রুডো নন। তিনি আগের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার নীতির পার্থক্যগুলোও তুলে ধরেন, যদিও তারা একই দলের নেতা। তিনি বিরোধীদের বাধা এড়িয়ে শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলেছেন।

তবে তিনি তার অতীত পেশায় বেসরকারি খাতে সম্পৃক্ততা এবং ধনী শ্রেণির প্রতি পক্ষপাতের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি অন্য  কারও কথা বলায় বাধা দেননি এবং পরিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত ভাষায় কথা বলেছেন যা সকলের শ্রদ্ধা কেড়েছে। যদিও কেউই অনন্য ছিলেন না, আমার ধারণা, মার্ক কার্নিই আগামী কানাডার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। তিনি সম্ভবত সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবেন।

তবে আগের প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর শেষ সরকারের চেয়ে বেশি আসন পাবেন। বিতর্কের আগে ভেবেছিলাম লিবারেলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিতর্কে কার্নি ও পলিয়েভ সমানে সমানে লড়াই করায় মনে হচ্ছে কনজারভেটিভরা বর্তমানের ব্যবধান কিছুটা কমিয়ে ফেলতে পারে। কানাডায় আগাম ভোট প্রদান শুরু হয়েছে গত শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ভোটাররা অগ্রিম ভোট প্রদান করতে পারেন। তবে জাতীয় ভোটের নির্ধারিত দিন হচ্ছে ২৮ এপ্রিল।

সেদিনই ভোট দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উল্লেখ্য, কানাডায় ভোট দেওয়ার জন্য কোনো ছুটি ঘোষণা করা হয় না। সবাই কাজের ফাঁকে ভোট দেয়, অথবা দুপুরের খাবার বিরতিতে ভোট দেয়। কেননা, এখানে ভোট দেওয়াকে মনে করা হয় নাগরিক দায়িত্ব। যারা দিনের বেলা কাজের ব্যস্ততার জন্য ভোট দিতে পারেন না, তারা চাইলে রাত ৯টা পর্যন্ত ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। দেখা যাক ট্রাম্পের বৈশ্বিক যুদ্ধ মোকাবিলায় কানাডা তাদের রাজনৈতিক সেনাপতি হিসেবে কাকে বেছে নেয়- কার্নি না পলিয়েভকে? 
এপ্রিল ১৯, ২০২৫

[email protected]

×