
কোনো কিছুকে টাকায় বা মুদ্রায় প্রকাশ করার প্রক্রিয়াকে মনিটাইজেশন
কোনো কিছুকে অর্থে বা টাকায় রূপান্তরিত করার বা কোনো কিছুকে টাকায় বা মুদ্রায় প্রকাশ করার প্রক্রিয়াকে মনিটাইজেশন (Monetijation) বা মুদ্রায়ন বলা হয়। অথবা কোনো কিছু থেকে টাকা করার প্রক্রিয়াকে মনিটাইজেশন বলে। কনটেন্ট হলো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের তথ্য-উপাত্তকে বোধগম্য করার উপায় যা বিভিন্ন মাধ্যম। যেমন- ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, পত্রিকা, টিভি বা রেডিও ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। কনটেন্ট বিভিন্ন ধরনের রয়েছে। যেমন- টেক্সট কনটেন্ট, ভিডিও কনটেন্ট, ইমেজ কনটেন্ট, ডক ফাইল ইত্যাদি।
তবে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জন্য ভিডিও কনটেন্ট, ইমেজ কনটেন্ট বেশি জনপ্রিয়। আর কনটেন্ট ক্রিয়েটর হলেন যে ব্যক্তি যা ভিডিও, লেখা, ছবি, অডিও, পোস্ট, গ্রাফিক্স, ওয়েবসাইট, ব্লগ পোস্ট, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ইত্যাদি তৈরি করে এবং প্রকাশ করেন। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা নিজের পেশাদার এলাকায় সামাজিক যোগাযোগ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সৃজনশীল কর্মকা- করেন। কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে ভালো কনটেন্ট তৈরি করার জন্য কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হয়। যেমন- ১. লক্ষ্য নির্ধারণ করা : প্রথমেই কনটেন্ট তৈরি করার আগে লক্ষ্য নির্ধারণ জরুরি।
কি করতে চাচ্ছেন এবং দর্শকদের কি ধরনের তথ্য প্রদান করতে চাচ্ছেন তা ঠিক করা। ২. দর্শকের জন্য অনুসন্ধান করা : দর্শকের চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভালো কনটেন্ট বানানোর জন্য কি বিষয়ে দর্শকরা আগ্রহী তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। ৩. শক্তিশালী শিরোনাম এবং শীর্ষক : কনটেন্টের একটি শক্তিশালী শিরোনাম এবং শীর্ষক নির্বাচন করা, যা ব্যবহারকারীদের আগ্রহ জোগানোর জন্য সহায়ক হবে। ৪. গবেষণা এবং পরিকল্পনা : অডিয়েন্সের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট তৈরির পরিকল্পনা ও গবেষণা করা। সে অনুযায়ী লেখা, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য কনটেন্ট তৈরিতে ভালোভাবে প্ল্যান করা এবং প্রয়োজনে স্ক্রিপ্ট তৈরি করা।
৫. ইন্টারঅ্যাক্টিভ এবং ব্যক্তিগত হওয়া : দর্শকের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করা হলে তা একটি সুস্থ কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। সেজন্য মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া এবং গ্রাহকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা। ৬. ঝঊঙ-এ মন্ত্রণা করা : কনটেন্ট সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজ করা, যাতে এটি সার্চ ইঞ্জিনে ভালোভাবে থাকে। ৭. ফ্রি সাবস্ক্রিপশন দেওয়া : ক্রিয়েটর একজন ব্লগার, ইউটিউবার, একক পোস্ট তৈরিকারক যাই হোক না কেন, কনটেন্টকে অনলাইনে বিনামূল্যে প্রদান করলে তা হতে পারে দর্শকদের একটি ভালো অনুভূতি। ৮. আপডেট এবং সম্প্রচার : নিয়মিতভাবে কনটেন্ট সম্প্রচার এবং আপডেট রাখা, যা পাঠকদের সার্বক্ষণিক আপনার কনটেন্টের সঙ্গে সংযোগ রাখতে সহায়তা করবে।
কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের আয়ের সুবিধার্থে মেটা প্ল্যাটফর্মের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক কনটেন্ট মনিটাইজেশন প্রোগ্রামে নিয়ে এসেছে বড় পরিবর্তন। নতুন এ সংস্করণে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট থেকে অর্থ উপার্জন করার সুযোগ সংযোজন করা হয়েছে। সংস্করণটিতে ইন-স্ট্রিম অ্যাডস, রিল অ্যাডস এবং পারফরম্যান্স বোনাসকে একটি একক প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের রিল, লং-ফরম্যাট ভিডিও এবং অন্যান্য পোস্ট থেকে উপার্জন করা সহজ হয়েছে। এটি কেবল রিল বা ছোট ভিডিওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ফটো এবং টেক্সট পোস্টও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও নতুন এই প্রোগ্রামে ‘পারফরম্যান্স বোনাস’ সিস্টেম চালু করা হয়েছে।
এটি ক্রিয়েটরদের কাজের গুণগত মান ও দর্শকদের ওপর নির্ভর করে বোনাস দেয়। এর মাধ্যমে ক্রিয়েটররা তাদের কাজের মান উন্নত করতে এবং সে অনুযায়ী যোগ্যতার মাধ্যমে আয় বাড়াতে পারছেন। অর্থাৎ, কনটেন্ট মনিটাইজেশন হলো আপনার নিজের তৈরি করা কনটেন্ট থেকে অর্থ উপার্জনের প্রক্রিয়া- যেমন নিবন্ধ, ভিডিও, পডকাস্ট বা যে কোনো ধরনের ডিজিটাল কনটেন্ট। এটি বিজ্ঞাপন, স্পনসরশিপ, সাবস্ক্রিপশন অথবা অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের মাধ্যমেও করা যায়। প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করার জন্য ফেসবুক কিছু নীতি আরোপ করেছে, যা মানা বাধ্যতামূলক।
ফেসবুকের কনটেন্ট মনিটাইজেশন নীতিগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে প্ল্যাটফর্মটি নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য এবং মানসম্মত থাকে। ফেসবুকে মনিটাইজেশন করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত ও নীতিমালা মেনে চলা প্রয়োজন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলো তুলে ধরা হলো : ১. যোগ্যতা মাপকাঠি (ঊষরমরনরষরঃু ঈৎরঃবৎরধ) : ফেসবুকে মনিটাইজেশনের জন্য নিচের বিষয়গুলো পূরণ করতে হয় : (ক) পেজ মনিটাইজেশন : আপনার পেজের কমপক্ষে ১০,০০০ ফলোয়ার থাকতে হবে। (খ) ভিডিও ভিউ : গত ৬০ দিনে কমপক্ষে ৬০০,০০০ মিনিট ভিডিও দেখা হতে হবে। (গ) কমপক্ষে ৫টি ভিডিও : কমপক্ষে ৫টি ভিডিও আপলোড করা থাকতে হবে।
২. কনটেন্ট মনিটাইজেশন পলিসি : ফেসবুকের মাধ্যমে আয় করতে হলে আপনার কনটেন্টগুলো এই নীতিগুলো মেনে চলতে হবে : (ক) কপিরাইট লঙ্ঘন নিষিদ্ধ : কপিরাইটকৃত মিউজিক, ভিডিও, বা ছবি ব্যবহার করা যাবে না। অন্য কারো কনটেন্ট অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে মনিটাইজেশন বাতিল হতে পারে। (খ) কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলা : হিংসাত্মক, বিদ্বেষমূলক বা আপত্তিকর কনটেন্ট নিষিদ্ধ। যৌন উত্তেজক বা অশ্লীল কনটেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। (গ) মূল্যবান এবং আসল কনটেন্ট : শুধু নিজের তৈরি করা বা আসল কনটেন্ট ব্যবহার করতে হবে।
ক্লিকবেট বা ভুল তথ্য প্রদান করা যাবে না। (ঘ) নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু : মাদকদ্রব্য, অস্ত্র এবং বেআইনি পণ্য প্রচার নিষিদ্ধ। রাজনৈতিক কনটেন্ট থেকে আয় করার বিষয়ে নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। (ঙ) শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ বজায় রাখা : কারও অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এমন কনটেন্ট এড়িয়ে চলা। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা বর্ণবাদী মন্তব্য নিষিদ্ধ। ৩. পেমেন্ট যোগ্যতা : (ক) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ট্যাক্স তথ্য : সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে। (খ) পেমেন্ট থ্রেশহোল্ড : সাধারণত ১০০ টাকা পূর্ণ হলেই পেমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হয়।
৪. মনিটাইজেশন টুলস : ফেসবুক বিভিন্ন মনিটাইজেশন টুল অফার করে, যেমন : (ক) ইন-স্ট্রিম অ্যাডস: ভিডিওর মধ্যে বিজ্ঞাপন। (খ) ফ্যান সাবস্ক্রিপশন : ফলোয়ারদের কাছ থেকে সাবস্ক্রিপশন ফি। (গ) ব্র্যান্ডেড কনটেন্ট: স্পন্সর করা কনটেন্ট তৈরি। ৫. ফেসবুকের সঙ্গে স্বচ্ছতা বজায় রাখা : ফেসবুকের সঙ্গে স্বচ্ছতা বজায় রাখা। যেমনÑ (ক) অ্যাকাউন্টের তথ্য সঠিক ও আপডেট রাখা। (খ) মনিটাইজেশনের কোনো নীতিমালা লঙ্ঘন হলে তা সংশোধন করা।
ফেসবুক মনিটাইজেশন সফল করার কিছু উপায় আছে। যেমনÑ ১. ফেসবুক পেজ তৈরি করা : আপনার একটি পেশাদার ফেসবুক পেজ থাকা দরকার। এটি আপনার ব্র্যান্ড বা বিষয়বস্তু পরিচিত করতে সাহায্য করবে। ২. কনটেন্ট তৈরি করা : নিয়মিতভাবে আকর্ষণীয় এবং মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরি করুন। ভিডিও, ছবি, পোস্ট ইত্যাদি আপনার দর্শকদের আকৃষ্ট করতে সাহায্য করবে। ৩. ফেসবুক ইনসাইটস ব্যবহার করা : আপনার পেজের দর্শক সংখ্যা, এনগেজমেন্ট এবং অন্যান্য বিশ্লেষণ জানতে ইনসাইটস ব্যবহার করুন।
এটি আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে কোন্্ ধরনের কনটেন্ট সবচেয়ে জনপ্রিয়। ৪. মনিটাইজেশন অপশন ব্যবহার করা : যেমনÑ ভিডিও মনিটাইজেশন: ফেসবুকের ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে আয় করতে পারেন, যেমন ফেসবুক ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেলস। ফেসবুক গেমস: গেমিং কন্টেন্ট তৈরি করে সরাসরি আয় করা যায়। ফ্যান সাবস্ক্রিপশন: আপনার ফ্যানদের সাবস্ক্রিপশন নিয়ে নিয়মিত আয় করতে পারেন। ৫. পণ্য বা পরিষেবা প্রচার করা: আপনার পেজের মাধ্যমে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করতে পারেন।
এটি অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে অথবা আপনার নিজস্ব পণ্য বিক্রির মাধ্যমে করা যেতে পারে। ৬. স্পনসরশিপ এবং ব্র্যান্ড সহযোগিতা : প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করে স্পনসরশিপের মাধ্যমে আয় করা। ৭. শিক্ষামূলক কনটেন্ট : কোর্স বা ওয়েবিনার আয়োজন করে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে ফি নিয়ে আয় করা।
একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর তার কনটেন্ট মনিটাইজেশন করে কত টাকা আয় করে তা নির্ভর করে উপরোক্ত শর্ত, নীতি ও যোগ্যতার ওপর। উচ্চ মানের কনটেন্ট, রিলেভেন্ট কনটেন্ট, কনটেন্ট সঠিক স্থানে রাখা, পেজের অনুসারী সংখ্যা এবং তাদের দেওয়া লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমেও আয় বাড়ে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়