ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

নির্বিচার বালু উত্তোলনে মৃতপ্রায় ইছামতী নদী

মিনহাজুর রহমান শিহাব

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২২ এপ্রিল ২০২৫

নির্বিচার বালু উত্তোলনে মৃতপ্রায় ইছামতী নদী

বিচ্ছিন্নভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ইছামতী নদী

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় পৌরসভার ঘাটচেক এলাকা ও হোছনাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রামে বিচ্ছিন্নভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ইছামতী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা। অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণহীন বালু উত্তোলনের কারণে হুমকিতে পড়েছে চাষাবাদের উপযোগী ফসলি জমি, নদীর দুকূলের বসতি জায়গা-জমি ও সহায়-সম্পদ।

ইছামতী নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীর পাড় রক্ষায় নেওয়া প্রকল্পও পড়েছে হুমকিতে।  উত্তোলিত বালু ভারী ট্রাক ও ডাম্পার দিয়ে পরিবহন করায় নষ্ট হচ্ছে স্থানীয় ফসলি জমি ও গ্রামীণ রাস্তা। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী ও শক্তিশালী বিভিন্ন স্থানীয় চক্র। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদল হলেও ইছামতী নদী থেকে সরেনি বালুখেকো চক্রের লোলুপ দৃষ্টি। এ কারণে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। 
স্থানীয়রা জানায়, ইছামতী নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০ ট্রাক বালু দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বর্ষায় এলাকায় বন্যা, জলবদ্ধতা ও নদীভাঙন দেখা দেয়। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনকে একাধিকবার অবহিত করা হলেও অজ্ঞাত কারণে কাক্সিক্ষত কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বালু পরিবহনকারী এক ট্রাক চালকের তথ্য মতে, তারা প্রতি ট্রাক বালু ৩০০-৪০০ টাকা দরে কিনছেন। এরপর এগুলো তারা বিক্রি করেন ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে। প্রত্যেক ট্রাক চালক প্রতিদিন ৭-৮ বার বালু নিয়ে যান ইছামতী নদীর ঘাটচেক ও মোগলহাটের অংশ থেকে। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রায় ৫০টি ট্রাক বালু পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। 
এসব বালু রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, রাঙ্গামাটিসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। আইন অনুযায়ী উন্মুক্ত স্থান ও নদীবক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন অত্যন্ত শাস্তিযোগ্য দ-নীয় অপরাধ। বালু ব্যবসায়ীরা প্রচলিত আইন অমান্য করে বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখায় আবাদি জমি, সংলগ্ন ব্রিজ-কালভার্ট ও রাস্তা বিপন্ন হচ্ছে বলে পরিবেশকর্মীদের অভিমত। তাদের মতে, অতীতে এ কারণে বহু আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এলাকাবাসী স্থানীয় প্রশাসন ও ভূমি অফিসে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাচ্ছে না। ভূমি অফিসের জনৈক কর্মকর্তাকে বিষয়টি অভিহিত করা হলে তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় এক পরিবেশ কর্মী বলেন, ‘প্রতিবাদ করেও নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না। বালু উত্তোলন করায় পৌরসভার ঘাটচেক, হোছনাবাদ ইউনিয়নের মোগলহাট, পারুয়া ইউনিয়ন এলাকায় বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙন দেখা দেয়। স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত।’ নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায়। 
পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘বালু উত্তোলনের বিষয়ে প্রায়ই আমাদের কাছে অভিযোগ আসে এবং আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা গ্রহণের। এ বিষয়ে সমন্বিতভাবে উপজেলা প্রশাসনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এখানে বদলি হয়েছি। তাই এ বিষয়ে অবগত নই। 
নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। অবৈধ ও বেআইনিভাবে যাতে কেউ পরিবেশ বিধ্বংসী বালু উত্তোলনের কাজ করতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি থাকবে।’ 
লেখক : পরিবেশকর্মী

×