ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

ফিলিস্তিন ॥ অস্ত্র-অর্থনীতির বর্বর শিকার

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২২ এপ্রিল ২০২৫

ফিলিস্তিন ॥ অস্ত্র-অর্থনীতির বর্বর শিকার

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘সন্ত্রাসবাদ’

ফিলিস্তিনি পাশ্চাত্যবিদ এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘সন্ত্রাসবাদ’ বিষয়ক এক বক্তব্য উল্লেখ করেছিলেন। সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘পাশ্চাত্য, ইসরাইল এবং ইহুদি ঐতিহ্য ও সভ্যতার সঙ্গে বিরোধিতা করে এমন যে কোনো কিছুই ‘সন্ত্রাসবাদ।’ ‘পশ্চিমা দুনিয়া প্রতিনিয়ত প্রচার করে সন্ত্রাসবাদ মানেই ইসলাম। সন্ত্রাসী মানেই ফিলিস্তিন, ইরান বা শিয়া মুসলমান।’ 
নেতানিয়াহুদের এ ধরনের ব্যাখ্যার অন্যতম সুবিধা হলো, ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদÑ এরকম ট্রেডমার্ক তৈরি করে একটি স্থায়ী প্রতিপক্ষ বানানো। যাতে নিজেদের প্রয়োজনে ওই প্রতিপক্ষকে খুঁচিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা যায়। ‘সন্ত্রাস’ দূর বা প্রতিহত করার নামে যা চলে তা কিন্তু নেতানিয়াহু বা তার প্রভুদের কাছে সন্ত্রাস নয়। দু’হাজার তেইশে এক যুদ্ধাভিযানের শুরুতে তিন ইসরাইলি তরুণের অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ অস্বীকার এবং হামাস দফায় দফায় রকেট নিক্ষেপ করে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙেছে বলে ইসরাইলি বিমান হামলা গাজায় যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল তাকে ‘সন্ত্রাস’ বা সন্ত্রাসবাদ বলার মতো বুকের পাটা কেউ দেখায়নি।

তিনজন ইসরাইলি অপহরণের বদলা হিসেবে একজন ফিলিস্তিনি তরুণকে অপহরণ ও পুড়িয়ে মারা এবং আরেকজনকে পুলিশি নির্যাতন করার কাজ যদিও আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। ওই যে পশ্চিমাদের ছড়িয়ে দেওয়া সন্ত্রাসবাদী তকমা ওটাই এখন বিশ্বময় ইসলাম ধর্মের পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী স্পেনের করডোভায় দীর্ঘ শাসনামলে একমাত্র মুসলমান শাসকরাই ইহুদিদের সমানাধিকার দিয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীনে। যুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় হলে ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। ব্রিটিশের তরফে সে সময় ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলÑ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে। উনিশশ’ আটচল্লিশ সালে ব্রিটিশের সহায়তায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিদের নিয়ে গঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রে ইহুদিরা সংখ্যালঘু হলেও প্রচ- ক্ষমতার অধিকারী।

পৃথিবীর যে কোনো দেশের ইহুদি এ রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে। বিশুদ্ধ ইহুদি রাষ্ট্র হয়ে ইসরাইল ফিলিস্তিনে আধিপত্য বিস্তার করতে করতে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে বিশ্ববাসী তা দেখছে। অথচ ওসমানীয় সাম্রাজ্যে এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও ফিলিস্তিনে আরব মুসলমান, আরব ইহুদি, আরব খ্রিস্টানরা একসঙ্গে বাস করত।
বছরদুয়েক আগে ইসরাইলি নিরাপত্তা ব্যূহ ভেদ করে রকেট হামলা চালিয়েছিল ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। জল, স্থল ও আকাশপথে চালানো এ হামলায় ইসরাইলের অন্তত ১৫০ নাগরিক নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিল ১ হাজার ১০০ জন। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর গত ৭৫ বছরে এই প্রথম ফিলিস্তিনের এমন আক্রমণ। পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে ফিলিস্তিন সেবার তীব্র হয়েছিল। যার খেসারত তারা এখনো দিচ্ছে ভয়াবহভাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের উদ্দেশে যুদ্ধ জাহাজ এবং যুদ্ধ বিমানসহ প্রায় সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করছে। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইল আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার পর মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ইসরাইলকে সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের নব্বই মিনিটের জরুরি বৈঠক থেকে যৌথ বিবৃতি আসেনি। এও এই প্রথম। পরিষদের ১৫ সদস্যের প্রতি হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানানোর আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্ত যৌথ বিবৃতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধের স্থায়ী সমাধান হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। 
শনিবার প্রত্যুষে হামলা শুরুর প্রথম ২০ মিনিটে দুই হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করা হয়। এতে অন্তত ১০০ জন নিহত হয়েছেন বলে ইসরাইলি গণমাধ্যমের বরাতে প্রকাশ করেছে আলজাজিরা। জবাবে পাল্টা রকেট হামলা চালায় তেলআবিব। এতে গাজায় অন্তত ২০০ জন নিহত হয়। আহত হয়েছে ১ হাজার ৬১০ জন। 
দুহাজার চৌদ্দয় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে, একদিনে ইসরাইলি বিমান থেকে ফেলা বোমায় নিহত হয়েছিল অন্তত একশ’ তিয়াত্তরজন ফিলিস্তিনি। যার বেশিরভাগই ছিল নারী এবং শিশু। আহত হয়েছিল এক হাজার দুশ’ ষাটজন। বাস্তুচ্যুত হয়েছিল পাঁচ হাজার ছয়শ’ জন। প্রায় সাড়ে নয়শ’ বাড়িঘরের স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুঃখ প্রকাশ করে সিবিএস টেলিভিশনকে বলেছেন, দুর্ঘটনাবশত যেসব বেসামরিক মানুষ মারা পড়েছে আমরা তাদের জন্য দুঃখিত। কিন্তু এ হতাহতের জন্য সম্পূর্ণভাবে হামাস দায়ী। 
কি চমৎকার আদব-কায়দা। গাজা উপত্যকায় প্রায় একতরফা নৃশংসতায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। হামলা বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও সম্প্রদায় থেকে জোর আহ্বান আসছে। জাতিসংঘ নামের ঠুঁটো জগন্নাথও হামলা বন্ধের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সব আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরাইল হামলা অব্যাহত রেখেছিল। কেন? হামাস নামের ‘ধর্মীয় ফ্যানাটিক’দের শিক্ষা দেওয়া বা সংশোধনের জন্য। যেন তথাকথিত ফ্যানাটিসিজম শুধু ইসলাম ধর্মেই আছে। 
প্রখ্যাত বাঙালি ইতিহাসবিদ ও প্রাচ্য বিশারদ তপন রায় চৌধুরীর এক মন্তব্যে বলেছেন, অক্সফোর্ডের বিভিন্ন সেমিনারে মুসলিম ফ্যানাটিসিজম কথাটি বহুবার শুনেছি, ক্রিশ্চিয়ান ফ্যানাটিসিজম বলে কিছু আছে বলে শুনিনি। অথচ শহরের প্রায় কেন্দ্রে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের পুড়িয়ে মারার স্মৃতিফলক রয়েছে। ইসরাইলের পিছনে বিপুল অস্ত্র সরবরাহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই যে শক্ত সমর্থন দিয়ে আসছে সেকথা ওপেন সিক্রেট। নিজেদের অস্ত্র বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতে পৃথিবীময় কোথাও না কোথাও যুদ্ধ পরিস্থিতি তাদের জিইয়ে রাখতেই হয়।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘একজন স্বৈরাচারী নিষ্ঠুর শাসকের বেপরোয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জবাবদিহিতা চাওয়া হবে। কোনো ধরনের ঘৃণ্য অস্ত্র এ পৃথিবীতে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না, এটাই এ গ্রহের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার।’ 
অসাধারণ ‘মানব দরদী’ অঙ্গীকার নিঃসন্দেহে। সারা পৃথিবীর সামরিক ব্যয়ের শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি (২০০৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী) নিয়ন্ত্রণকারী এবং বিশ্ব পুঁজিবাদের  কেন্দ্র হিসেবে নিজের দাপট অক্ষুণœœ রাখতে যে দেশ অস্ত্র-অর্থনীতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত    নিয়েছে, পৃথিবী নামের গ্রহ রক্ষার জন্য সে দেশের প্রেসিডেন্টের মুখে এমন অঙ্গীকারই মানায় বটে।

×