
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের পাহাড় ও সমতল এবং ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা ও উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চল ও সমতলে কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। তবে দুঃখজনক হলো, ৫১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ৪১টির নিজস্ব মাতৃভাষার মধ্যে ১৪টি বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। এটাও সত্য যে, প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা, ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান, আহার-বিহার, সর্বোপরি শিল্প-সংস্কৃতি।
তাদের মধ্যে অন্যতম গারোদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উৎসব। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেটের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং গাজীপুরের শ্রীপুরে গারোদের বসবাস। তবে তারা নিজেদের মান্দি বা মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে গারোদের আদি বসতি।
গারোদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য রয়েছে, যা বেশ পুরানো। তবে ধর্মান্তরের ফলে বিশেষ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের কারণে একদিকে যেমন তারা উন্নত, শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ হয়েছেন, অন্যদিকে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে তাদের পুরানো ধর্ম-সংস্কৃতি ও উৎসব। গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক। তাদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এ ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য দেবতাÑ মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়াসহ নানা দেবতা। যাদের তারা সাংসারেক রীতিনীতি অনুযায়ী পূজা-পার্বণসহ নাচ, গান, বাদ্যসহ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে থাকে সাড়ম্বরে।
তবে গারোদের প্রধান উৎসব ওয়ানগালা, যা তারা প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মহা ধুমধাম করে পালন করে। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই উৎসবে ব্যাপক আচার- অনুষ্ঠান ঢাকঢোল, নিত্যগীত ও বাদ্যসহ সবাই মিলে একসঙ্গে সাড়ম্বরে পালন করে। এটি তাদের সর্বাধিক জনপ্রিয় উৎসব, যা সাংসারেক ধর্মীয় বিশ্বাসী ছাড়াও সবাই অংশগ্রহণ করে। এর বাইরেও রয়েছে মৃত ব্যক্তি তথা পরলোকগত পূর্বপুরুষদের স্মরণে খিম্মাসঙা বা স্মরণানুষ্ঠান। বলাবাহুল্য, এসব আচার-অনুষ্ঠান গারো সংস্কৃতিকে করেছে মনোরম, আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৯৫৭ সালের ৫ জুন ৪০তম অধিবেশনে ১০৭ নং কনভেনশনে আদিবাসী ও উপজাতীয় ভাষা বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে কিছু নীতিমালা তৈরি করে। এ কনভেনশনে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরকারী অন্যতম দেশ। কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২১-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় জনসমষ্টির অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সকল স্তরে শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
তাদের গান, ছড়া, কবিতা, উপকথা, রূপকথা, মিথোলজি- এগুলো বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে অবিলম্বে এগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনই যথাযথ মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাইয়ের শিক্ষার্থীদের অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকেও।