
বাংলাদেশ ২০২৬ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে হলে একটি দেশকে বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। উন্নয়নশীল শব্দটার মধ্যে শুরুতেই যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় তা হলো ‘উন্নয়ন’।
উন্নয়ন বলতে বোঝায় একটি তত্ত্ব বা পদ্ধতি যা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবেশগত পরিশুদ্ধিসহ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়ের ইতিবাচক পরিবর্তন। একটি দেশের উন্নয়ন কে ত্বরান্বিত করার পূর্ব শর্ত হলো উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
সেই উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ধরন, অগ্রগতি ও ফলাফল নির্ভর করে একটি দেশের শাসনতান্ত্রিক অবকাঠামোর ওপর। যার ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, একটি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত ও বাস্তবায়িত হতে হলে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শ্লথ গতিতে পরিচালিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য।
লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বলতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তথা আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি বোঝায়। আমলাতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতা, দীর্ঘসূত্রতা, নিয়মকানুনের কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়িই হলো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের ফলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিভিন্ন বিষয় ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে থাকে।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে প্রশাসনিক তৎপরতার ওপর একটি জরিপ করে। সেই জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে একটি প্রকল্প প্রণয়নে সর্বোচ্চ সময় লাগে ১৭৩৫ দিন, প্রায় পৌনে পাঁচ বছর এবং গড়ে ২৮৫ দিন, প্রায় সাড়ে ৯ মাস।
প্রকল্প প্রণয়নে একটি ফাইলকে সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে গড়ে ৩২টি স্বাক্ষর এবং নামতে ৩১টি স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে একটি ফাইলের লাগে সর্বোচ্চ ১৬৩৫ দিন, প্রায় সাড়ে ৪ বছর।
সর্বনিম্ন ৯২ দিন, গড়ে ২১২ দিন, ওপরে উঠতে স্বাক্ষর পড়ে ২৯টি, নামতে স্বাক্ষর থাকে ২৭টি। যা একটি দেশের উন্নয়নকে কতটা বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আবার বাংলাদেশের অন্য একটি জরিপে দেখা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ার একটি ফাইলকে সহকারী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে মন্ত্রী হয়ে আবার ফিরে আসতে ৫২টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
অনুমোদিত প্রকল্পে তহবিল প্রদান করতে ৫৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এই সমস্ত কারণে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে না। ফলে জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে যে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা পরিদৃশ্যমান, তাকে আরও এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের মতো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা। এর জন্য সরকারের নিয়মকানুন ও প্রক্রিয়াগুলি সংস্কার করা প্রয়োজন।
নিয়মকানুন গুলিকে প্রয়োজনীয় ও সহজবোধ্য করার পাশাপাশি প্রক্রিয়াগুলিকে স্বচ্ছ ও দ্রুততর করা দরকার। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান বাধা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। সম্প্রতি টাস্ক ফোর্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো ‘অতি নিয়ন্ত্রণ এবং আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য’।
সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য এবং দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করতে হলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করণের মাধ্যমে এবং প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। যা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল করতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
কুতুবে রব্বানী