
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুভযাত্রায় দেশের উদীয়মান শিক্ষার্থীর সচেতন অংশগ্রহণ জাতির জন্য কাক্সিক্ষত এবং জরুরি ছিল। যার ফলে দীর্ঘ ১৬ বছরের অপশাসন আর দুঃসময় মোকাবিলায় সমাজ কাঠামোর মূল ভিত্তিই নড়বড়ে হতে সময় লাগেনি। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।
এমন সুচিন্তিত প্রবাদবাক্যের ব্যত্যয় সমাজ সংস্কারের বাতাবরণে আঁচ লাগলে দেশ ও জাতির শুভসংকেত সামনে আসাও কঠিন। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনের জোরদার দাবিতে পুরানো সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠাও ঐতিহাসিক নিয়মের অধীন।
শাসন ক্ষমতায় স্বেচ্ছাচার আর একাধিপত্যে সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে যে লাগাতার অসময় তাও কোনোভাবে স্বস্তিদায়ক ছিল না। সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা সব সময় বলে আসছেন লাগাতার যে কোনো পুরানো সংস্কার সমাজের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে দুর্বল করে দিতে বরাবরই সক্রিয় থাকে।
তারই অপঘাত আর প্রতিক্রিয়ায় মানুষের জীবনাচরণেও আসে অস্থিরতার দুঃসময় যাতনা। ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারায় নতুন সময়ের অবগাহনে সুচিন্তিত জ্ঞানের জগতেও আসে এক প্রণালীবদ্ধ ধারাবাহিকতা।
অতি আদি কৌম সমাজ থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন সমাজ কাঠামোর ভিত তৈরি হওয়া সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতির ন্যায্যতা। প্রতিটি সমাজ তার নিজস্ব সংস্কারবোধ, জীবনাচরণ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিতই শুধু নয় সংঘবদ্ধও হয়।
আপন সাংস্কৃতিক বেড়াজাল, প্রকৃতিগত বরমাল্য কিংবা বিপরীত প্রদাহে ভাঙনের কবলে পড়াও চলার পথের নানামাত্রিক সংকট। তেমন বিপদাপন্ন প্রতিকূল পরিবেশ থেকেই নতুন করে বাঁচার, টিকে থাকার তাগিদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের চলমান প্রক্রিয়া।
আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশও ইতিহাসের ক্রমবর্ধমান যাত্রাপথে শুভ-অশুভ, দুর্যোগ আর দুর্ভোগের পালাক্রমের জীবনকে সুসংহত করতে লড়াই-সংগ্রামকেও নিত্যদিনের অনুষঙ্গ করেছে। সমুদ্রবেষ্টিত আর নদ-নদী বিধৌত আবহমান বাংলা বরেন্দ্র অঞ্চলের উর্বর পলিমাটির দেশ।
যে দেশের উর্বর পলিমাটিতে নাকি বীজ মাত্র সোনা ফলে। তবে শুধু বীজ বপন করেই কখনো ক্ষান্ত থাকেননি চাষাবাদে সম্পৃক্ত অসংখ্য কৃষক। পায়ের ঘাম মাথায় ফেলে উদয়স্ত পরিশ্রমের অনন্য সোপান আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ।
তবে শাশ্বত বাংলা তার আপন শৌর্যে বরাবরই অম্লান থাকার দৃশ্যপট সহনীয় এক স্বাধীন, মুক্ত, পরিবেশ। যুগ-যুগান্তরের অস্ট্রিক জাতি গোষ্ঠীর দীর্ঘ কর্মযোগের যে দুঃসাহসিক অভিগমন সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াও সহজাত চেতনার নিগূঢ় মেলবন্ধন।
পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান- পতনের ধারাবাহিক পালাক্রম। দিল্লির রাজন্যবর্গ গোটা ভারতবর্ষকে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করলেও বাংলাকে নাকি কখনো বশীভূত করা যায়নি বলে ইতিহাসে বিধৃত আছে।
কারণ বর্বর উপজাতীয় সর্দাররা বাহুবল আর সৈন্য সামন্ত নিয়ে দিল্লির মসনদ অধিকার করলেও বাংলাদেশের সীমানায় কখনো আঁচড় বসেনি। শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি আর মননে অস্ট্রিক জাতি গোষ্ঠীর বাংলা ছিল উন্নত সভ্যতা আর সংস্কৃতির ধারক-বাহক।
সঙ্গত কারণে বর্বর উপজাতীয় সর্দাররা দিল্লিকে নিজেদের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হলেও বাংলার ব্যাপারে বরাবরই পরাভূত হয়েছে। ধনধান্য পুষ্পে ভরা শস্য শ্যামল চিরায়ত বাংলা আপন সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক দ্যোতনায়ও ছিল এক অপরাজেয় শক্তি।
ব্রিটিশরাই প্রথম জাতি যারা জ্ঞানে, সভ্যতা আর উন্নত সংস্কৃতিতে আবহমান বাংলার চাইতেও অগ্রগামী ছিল বলে বিভিন্ন পণ্ডিতের লেখায় উঠে আসছে। সে কারণে ইংরেজদের প্রতিহত করা অপরাজেয় বাংলার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
দুইশ’ বছরের ইংরেজ শাসন-শোষণ বাংলার সম্পদকে যেভাবে সে দেশে পাচার করেছিল সেটাও ইতিহাসের আর এবং মরণ কামড়। পণ্ডিতরা এমনও বলেছেন ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন না হলে ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব হতো কি না তা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
জেমস ওয়াটের ইস্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগেও বহু প্রযুক্তির সলিল সমাধি হওয়া যান্ত্রিক সভ্যতার লাগাতার দুর্ভোগ। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শুধু যন্ত্র উদ্ভাবনই যথেষ্ট নয় তার চেয়ে বেশি জরুরি সংশ্লিষ্ট অর্থ। যা নেওয়া হয়েছিল ঐশ্বর্যশালী বাংলার কোষাগার থেকে।
১৭৬০ সালের শিল্পবিপ্লবের কয়েক বছর পরেই ১৭৬৯ সালে বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তা আজও ইতিহাসের ক্ষতবিক্ষত অধ্যায়। বাংলায় ১২৭৬ সাল যাকে বিজ্ঞজনেরা ’৭৬-এর মন্বন্তর বলতে দ্বিধা করেননি। ধারণা করা হয় এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায় অনাহারে, অর্ধাহারে।
সেই শুরু শ্যামল বাংলার ওপর বিদেশী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবল অর্থ আত্মসাৎ। সেখান থেকে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ কোনোভাবেই জাতীয় জীবনে স্বস্তিদায়ক হয়নি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নতুন আর এক চেতনাসিদ্ধ পালাক্রমের নব অঙ্গীকার।
যার পরিণামে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার স্বচ্ছ দলিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন আর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরম্পরার এক অভাবনীয় দ্যোতনা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন বাঙালির জন্য অনন্য গৌরব গাথার নির্মাল্য।
লাল-সবুজের নির্মল পতাকায় সর্ববাঙালির একীভূত হওয়া ঐতিহ্যিক পালাক্রমের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা। স্বাধীন, স্বদেশ বঙ্গভূমির স্বজাত্যবোধের পরম অহঙ্কার আর অর্জনের নিরবচ্ছিন্ন পালাক্রম। স্বাধীন বাংলা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছিল আপন গৌরবে নিজস্ব গতিপথে।
কিন্তু পরবর্তীতে একচেটিয়া বশীভূতকরণের যে অরাজক অধ্যায় সেখানেও ছিল একাধিপত্য। নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অন্যমাত্রার রুদ্ধতার বেষ্টনী। তেমন পালাক্রমে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত যে শাসন ক্ষমতার অপব্যবহার, দলগত স্বেচ্ছাচারিতা, অঞ্চলভিত্তিক পেশিশক্তির চরম দুর্বৃত্তায়ন কাঠামোর গভীরতর শিকড়ে পৌঁছে দেড় দশকেরও অধিক সময় দেশটার যে নয়-ছয় দুরবস্থা তাতে ভাঙনের দাবানল শুরু হতেও দেরি হয়নি।
হরেক অত্যাচার, অবিচার, ক্ষমতায়নে পেশিশক্তির দুর্দমনীয় প্রভাব প্রতিপত্তি তাতে রাষ্ট্রের মূল উপাদানে আঁচড় লাগতে বেশি অপেক্ষা করতেও হয়নি। উদীয়মান জাতির ভবিষ্যৎ কারিগর অগণিত শিক্ষার্থীর আন্দোলন-সংগ্রাম ক্ষমতাসীন সরকারের মসনদ নড়ে ওঠে। লাগাতার ক্ষমতার অপব্যবহার কোনো রাষ্ট্র কিংবা জাতির জন্য মঙ্গল হয়ই না।
ষোড়শ শতাব্দীর আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়াভেলি তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করলেন সকল ক্ষমতাই মানুষকে বিকৃত করে। চরম ক্ষমতা চরমভাবে বিকৃত করতে পিছু হটে না। তিনি তার পূর্ববর্তী শাসকদের ক্ষমতা আগ্রাসনের চরম দৃষ্টতা থেকেই এমন তত্ত্ব দিতে পেরেছিলেন।
সময় সব প্রমাণ করে দিল। ২০০৮ সালের পর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দেশে কোনো গণতান্ত্রিক পর্যায়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোট প্রদান সুষ্ঠুভাবে হয়ইনি। নির্বাচনের নামে জালিয়াতি, কারচুপি আর প্রহসনের নাটক সাধারণ মানুষদের ধোঁকা দিলেও শেষ অবধি ইতিহাস বিকৃতির দাম ইতিহাসের ধারায় দিতে হয়েছে।
নতুন সময়ের আধুনিক জাতি গড়ার কারিগর উচ্চ শিক্ষা পাদপীঠের অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর যৌক্তিক আন্দোলনের চলমান স্রোতধারায় মিলে-মিশে নবতর দেশ গঠন প্রক্রিয়া আলোর নিশানায় পথ খুঁজে পাওয়া ইতিহাসেরই আর এক নব অভ্যুত্থান।
যা উদীয়মান জাতি গড়ার সময়ের কারিগররা আপামর মানুষকে এক সুতায় নিয়ে এসে নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করলেন। যা বাংলাদেশের অর্ধ শতক পার করা ইতিহাসেরও পরম নৈবদ্য। সামনে জাতি অপেক্ষমাণ আর এক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক অধিকারে।
সুষ্ঠু স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে সর্ব মানুষের ভোট প্রদান নির্বিঘ্ন আর নিরবচ্ছিন্ন হবে-এই প্রত্যাশায় বাংলাদেশের সার্বিক মানুষ।
কুতুবে রব্বানী