
আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে কিছুটা অস্বস্তিকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান। জনগণের মাঝেও ভয়ভীতি, ক্ষোভ, সঙ্গে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কমতি নেই। দেশের স্বাস্থ্যসেবার এমন চালচিত্রের মধ্যেই গত ৭ এপ্রিল সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়ে গেল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২৫’। এই দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে- ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’। এর উদ্দেশ্য হলো প্রতিরোধযোগ্য মা ও নবজাতকের মৃত্যু বন্ধ করার প্রচেষ্টা জোর করা এবং নারীদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রতিপাদ্যের আলোকে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হলো। সারাবিশ্বে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। ২০২৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল ভাবনা মা ও শিশুর স্বাস্থ্য। সুস্থ পরিবার সমাজের ভিত্তি, যা আমাদের সকলের জন্য আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের মাধ্যমে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তারা সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মানুষ যেন আর্থিক অসুবিধা ছাড়াই প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা সহজে পেতে পারেন। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩০ ভাগই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পান না এবং প্রায় দুইশ’ কোটি মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন। বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত বলছে, এক্ষেত্রে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (পিএইচসি) ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকরী এবং ব্যয়-সাশ্রয়ী পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, কথাটি শুধু কথার কথা নয়। শরীর-মন ভালো না থাকলে ব্যক্তির জীবন কখনো সুন্দর হয় না। কাজকর্মে ও জীবন যাপনে আসে নানা রকম বিঘ্ন। নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেমন প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনই সব দেশের নাগরিকদেরই মৌলিক চাহিদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিকিৎসাসেবা। স্বাস্থ্য সুরক্ষা যে কোনো দেশের মানুষের অন্যতম চাওয়া। আর জনগণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া একটি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল অংশ। যেটি কার্যকরভাবে পরিচালিত করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্জন নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশে আপামর মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শহরকেন্দ্রিক কিছু অবকাঠামো থাকলেও গ্রামাঞ্চলে সরকারিভাবে প্রাথমিক কোনো কাঠামো কার্যকরভাবে এখনো গড়ে ওঠেনি।
এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে ‘মাতৃ ও শিশু’ স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। দেশে গত দুই দশকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পর তা থমকে গেছে। এতে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু একই জায়গায় অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২৩ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এ হার একই ছিল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক শিশুমৃত্যু ও এক মাসের কম বয়সী নবজাতকের মৃত্যুহার বেড়ে গেছে। প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে ২০ জন মারা যায়। ২০২১ সালে প্রতিহাজার নবজাতকের মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬। ২০২৩ সালে প্রতি এক হাজার জীবিত শিশুর জন্মের পর ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। শিশুমৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় প্রতীয়মান হয় দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা, প্রসব উত্তর সেবার কার্যক্রম ঠিকভাবে হচ্ছে না। নবজাতক মৃত্যুর কারণ জন্মগত ক্রটি, অপরিণত জন্ম, জন্মের সময় ওজন কম, শ্বাসকষ্ট এবং বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ। এসব কারণ দূর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শিশুমৃত্যু কমছে না।
মাতৃমৃত্যুর হারও বেড়েই চলছে। যার কারণ প্রসূতির রক্তপাত, অসংক্রামক রোগসহ উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, অনিরাপদ ডেলিভারি, গর্ভপাত ও অন্যান্য জটিলতা। এছাড়াও অনেক হাসপাতালে মিডওয়াইফ ও জরুরি ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স নেই। এমনকি চিকিৎসক থাকলেও রয়েছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। ফলে, মাতৃমৃত্যু বেড়েই চলছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, মাতৃমৃত্যুর ৪৮ ভাগই হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে ১৯ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে মারা যায় ১৩ শতাংশ। ৪৭ শতাংশ প্রসূতি প্রসবপরবর্তী সেবা পান না।
শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে যে উদাহরণ তৈরি করেছিল, তা এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। অর্থ সংকটে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রের সেবা কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধির স্পষ্ট ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এছাড়াও উন্নয়ন অংশীজনদের সম্ভাব্য তহবিল কাটছাঁটের কারণে বাংলাদেশে প্রসূতি স্বাস্থ্যের অগ্রগতি ঝুঁকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ নারী গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের কারণে মারা যায়, ২০ লাখের বেশি শিশু তাদের জীবনের প্রথম মাসে মারা যায় এবং প্রায় ২০ লাখের বেশি মৃত জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রতি সাত সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হয়, যা প্রতিরোধযোগ্য। দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অপর্যাপ্ত যত্নের অভাবে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু বাড়ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় বিনিয়োগ বাড়ানো, সব পর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী বিশেষ করে ধাত্রী সংখ্যা বাড়ানো এবং সঠিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা গেলে লাখ লাখ শিশু ও মাকে বাঁচানো সম্ভব।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০ জনের নিচে এবং নবজাতক মৃত্যুর হার ১২ জনের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নতি না হলে এবং এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে গর্ভবর্তী নারীর জীবন রক্ষা এবং প্রতিরোধযোগ্য প্রসূতি মৃত্যু নিরসনের অগ্রগতি অর্জন অব্যাহত রাখতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রাখা আবশ্যক। এছাড়া শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় জোর দিতে হবে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে অধিকতর কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অনেক সময় শিশু কোনো রোগ নিয়ে জন্মানোর অর্থ হলো সে জিনগতভাবে রোগাক্রান্ত। সুতরাং শিশু জন্মানোর আগে তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাও আবশ্যক। এতে দারিদ্র্য কমবে, সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
মা ও নবজাতকের সুস্থতার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি মা সুস্থ থাকেন, তবে বাচ্চা সুস্থ থাকবে। দেশ ও জাতি সুস্থ থাকবে। মা যদি দুর্বল হয়, অসুস্থ হয়, অপুষ্টিতে ভোগে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পায়, তাহলে শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগবে, শিশুর ওজন কম হবে, বিভিন্ন রোগে ভুগবে, সময়ের আগে জন্মাবে, শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে। শিশুর পুষ্টির দিকে ও গর্ভধারণের সময় থেকেই নজর দিতে হবে। কারণ, মায়ের খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্য গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে জন্মের পর শিশুর পুষ্টি চাহিদা বয়স ও বিকাশ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়, এ কথাও খেয়াল রাখতে হবে।
আরও একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে দৈনন্দিন সুষম খাদ্যের অভাবে পুষ্টি ঘাটতি সুবিদিত। নারী ও শিশুর মধ্যে তা আরও ব্যাপক। গর্ভবতী নারী ও শিশুর ক্ষেত্রে বাড়তি পুষ্টির প্রয়োজন, তা মাথায় রাখতে হবে। আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ও মিনারেল এর অভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে, এর সঙ্গে আরও প্রকট হচ্ছে জিংকের ঘাটতি। এগুলো সরবরাহের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নতিকল্পে উপজেলা, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সব চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামো ও সরঞ্জামের মান উন্নয়ন, জরুরি প্রসূতি ও নবজাতক সেবা দেওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি রেফারেন্স ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি তৃণমূল পর্যায়ে সব রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ এবং অস্ত্রোপাচার প্রায় সবই বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।
আমাদের মনে রাখা উচিত, একজন মা যদি সুন্দর স্বাস্থ্যকর সন্তান জন্ম দিতে না পারেন, যদি নবজাতক জন্মের পরেই মারা যায়, তাহলে দেশের অন্যান্য উন্নয়ন মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তাই আমরা চাই বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আর কোনো মা যেন অবহেলায় মারা না যায়, কোনো শিশু জন্মের পরেই ঝরে না পড়ে। আমাদের প্রত্যাশা, যত দ্রুত সম্ভব তৃণমূলের সকল স্বাস্থ্য সেবা দ্রুত চালু করা, কোনো রোগী যেন ওষুধ এবং ন্যূনতম সেবা না নিয়ে শূন্য হাতে ফিরে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিশু ও মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে গর্ভ ও প্রসবকালীন যত্নের বিষয়ে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টির গুরুত্ব, টিকাদান কর্মসূচি এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করার জন্য ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালাতে হবে। এসব বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, নবজাতক ও মাতৃস্বাস্থ্যের অগ্রগতির জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, দেশী-বিদেশী সংস্থা ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক
প্যানেল