ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

রাজধানীর দূষণ রোধে করণীয়

কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী

প্রকাশিত: ২০:১৯, ২০ এপ্রিল ২০২৫

রাজধানীর দূষণ রোধে করণীয়

বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী আর অর্ধশতাধিক খাল নিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যে গড়ে উঠেছিল, আজকের রাজধানী ঢাকা শহর। কালের স্রোতে এসব দৃষ্টিনন্দন নদী-খাল আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশবান্ধব নগরী আজ রূপ নিয়েছে দূষিত শহরে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে সবাই বড়লোক হওয়ার ধান্ধায় থাকে। যার ফলে নদী-খাল ভরাট করে গড়ে তুলেছে অসংখ্য ঘর-বাড়ি, শিল্পকারখানা আর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। এ শহর নানা কারণে দূষিত হচ্ছে। তন্মধ্যেÑ বায়ুদূষণ, পরিবেশ দূষণ, আলো দূষণ, খাদ্য দূষণ, রাজনৈতিক দূষণ, সাম্প্রদায়িক দূষণ, শব্দদূষণ, নদী-খাল দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ, জলাবদ্ধতা, ঘনবসতি অন্যতম। পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকার কারণে দিন দিন কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর অক্সিজেন কমছে। কারণ, গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে আর বাতাসে অক্সিজেন দেয়। একটি শহরের ১০-১২ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। ঢাকায় ৩ শতাংশও নেই। সবুজ থাকতে হয় ১৫ শতাংশ। আছে ৭ শতাংশের কম। ঢাকায় ৩ শতাংশ গাছ রয়েছে। যদিও থাকার কথা ৭ শতাংশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, মন্ত্রীপাড়া, বলদা গার্ডেন, জিয়া উদ্যান (চন্দ্রিমা উদ্যান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু কিছু জায়গায় সবুজায়ন রয়েছে। ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরে মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ এবং পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। মোট বৃক্ষ-আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।
বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া। কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এতে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। অথচ যানবাহনের কালো ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা নিশ্বাসে যে বায়ু নিচ্ছি তা নির্মল নয়। কারণ, বাতাসে আছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অনেক পদার্থ; যা খালি চোখে দেখা যায় না। বায়ু দূষণের জন্য অনেকটাই দায়ী যানবাহনের কালো ধোঁয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসকে দূষণে ভারি করে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ু দূষণের জন্য এখন ৫০ ভাগ দায়ী মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ধোঁয়া। এই তালিকায় আছে বাস, লেগুনা, মটর রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস। বিশেষ করে মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকেই বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া; যা বিষাক্ত। বাংলাদেশে যে হারে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং এসির ব্যবহার হয়, উন্নত বিশ্বে এত পরিমাণ গাড়ি এবং এসির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এজন্য ঢাকার তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গাড়ির হর্নের শব্দদূষণ তো নিত্যদিনের ঘটনা। আজকাল ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পলিথিন এবং বর্জ্য আগুনে পোড়ানোর কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। যার ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ঢাকার মীর হাজীরবাগ, জুরাইন, ধোলাইপাড়, ধোলাইখাল, নবাবপুর এরিয়াতে ইস্পাত, প্লেট, সিট, লোহাজনিত জিনিসপত্র বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গলানো, পোড়ানো এবং কাটানোর ফলে অতিরিক্ত বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণ হচ্ছে। ঢাকা কাকের শহর। গ্রামের মানুষের যেমন ঘুম ভাঙে মোরগের ডাকে, তেমনি ঢাকাবাসীর ঘুম ভাঙত কাকের ডাকে। শহরের আনাচে-কানাচে এই পাখির সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। নানা কারণে এখন ঢাকায় কমছে কাকের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যের সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নির্মম আধিপত্যের আধিক্যের কারণে আগের মতো জন্মাচ্ছে না নগরপক্ষী চিরচেনা কাক। কাক ময়লা-আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু দূষণ এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কাকও ঢাকা শহরে বসবাস করতে পারছে না।
মিরপুুরসহ ঢাকা শহরের নানা জায়গায় ডাইং কেমিক্যাল শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার কারণে প্রতিনিয়ত নদী ও খালের পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হয়ে পানিদূষিত হচ্ছে। আলো দূষণ, ইংরেজিতে একে বলা হয় লাইট পলিউশন। মানুষ এবং প্রাণীদের দিনের কর্মযজ্ঞের যে চক্র থাকে; তাতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শরীরের আলো থেকে দূরে থেকে বিশ্রাম দরকার। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় এবং বেশি সময় ধরে জ্বলে থাকা আলো অস্বস্তি আর বিরক্তির পাশাপাশি অন্য সমস্যাও তৈরি করে। সহজভাবে বলতে গেলে, কোথাও যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রার আলো থাকে বা কোথাও যদি অপ্রয়োজনীয় আলো থাকে, তাহলে সেটিও আলো দূষণ। এই দূষণের জন্য মূলত দায়ী কৃত্রিম আলো। তবে ঠিক কত মাত্রার আলো হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। কারণ, কোনো স্থানে কতটুকু আলো প্রয়োজন, তা অনেক ধরনের নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে। যেমনÑ স্থানের ধরন, আয়তন, গুরুত্ব ইত্যাদি। ঢাকাসহ সারা দেশে আলো দূষণের পেছনে সড়কবাতির পাশাপাশি বিলবোর্ডের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। বিলবোর্ডের আলো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয় এবং তাতে বিজ্ঞাপন চলে। এতে ড্রাইভারদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। বিলবোর্ডগুলোতে এত উচ্চমানের কেলভিনযুক্ত আলো থাকে যে, দিনের বেলায়ও বিলবোর্ডগুলো স্পষ্ট দেখা যায় এবং রাতে তা আরও প্রকট হয়ে চোখে অস্বস্তি তৈরি করে। এগুলো দুর্ঘটনার জন্যও দায়ী। কিন্তু আমাদের দেশে তো কোনো নিয়ম নেই। আলো দূষণবিষয়ক সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সড়কবাতি বা বিলবোর্ডের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো কোনো নির্দেশনা নেই। সড়কবাতি বা বিলবোর্ডের যে লাইট বসানো হয়, তা আকাশের দিকেও যায়, সড়কের দিকেও আসে। সেগুলো কীভাবে বসাতে হবে, বিলবোর্ড কেমন হবে, তা নিয়ে কোনো স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা নেই। বিলবোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এমনকি রিকশা করে কোনো বিলবোর্ড ক্রস করলেও ঠিক এমনই অনুভূত হবে।
সাম্প্রদায়িক দূষণ বলতে বোঝায় এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে বিনা কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে হেস্তন্যাস্ত বা আক্রমণ করা। এ সমস্ত ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে ঢাকা শহরের নানা জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রপাত করা হয়। রাজনৈতিক দূষণ বলতে বোঝায়, একটা রাজনৈতিক দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখল করে রাখে এবং অপর দলগুলোকে সুযোগ দেয় না। লোনের টাকা দিয়ে বড় বড় প্রকল্প চালু করে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকাকে দুর্বিষহ করে তুলে এবং দেশের অর্থ বাইরে পাচার করে। দেশ ও জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে যে অস্থিরতা বিরাজ করে এবং সময় সময় সরকারের বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশে^  যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, তাকে বলে রাজনৈতিক দূষণ। খাদ্য দূষণ ঢাকাবাসীর জন্য নিত্যদিনের একটি ঘটনা। খাদ্যের মধ্যে নানা জৈবিক পদার্থ, বিদেশী পর্দাথ এবং রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার রান্না ও পরিবেশন এবং রাস্তার পাশে যে সমস্ত রেস্টুরেন্ট বা খাবারের দোকান রয়েছে, প্রতিটি খাবারে ধুলাবালি পড়ে। যার ফলে খাবারে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত খাবার খাওয়ার ফলে মানুষ ও প্রাণীদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি হয়।
জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা। বর্ষার মৌসুমে একটু বৃষ্টি পড়লেই ঢাকা বহু জায়গায় হাঁটু সমান পানি হয় এবং বাসার নিচতলা তলিয়ে যায়। আগেকার সময়ে ঢাকা শহরে বৃষ্টি হলে নদী-খাল হয়ে পানি নেমে যেত। এখন সে সুযোগ নেই। কারণ, অধিকাংশ খাল ভরাট করে বিল্ডিং করা হয়েছে। অতিরিক্ত জনবসতির কারণে রাজধানীর পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দিন দিন। ঢাকাকে এক নজরে দেখলে মনে হয় এটি কোনো রাজধানী নয়; বরং এটি একটি শিল্প অঞ্চল বা অথনৈতিক জোন। বিশে^র উন্নত রাষ্ট্রের রাজধানীতে এত পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখা যায় না।
সরকার ও জনসাধারণের উচিত ঢাকা শহরকে দূষণমুক্ত করা। প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেওয়া। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে সুনজর দিলে এ সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। অন্যথায়, পরিবেশের আরও বিপর্যয় ঘটবে এবং এক সময় ঢাকা শহর মৃত্যুপুরী বা অস্বাস্থ্যকর নগরী হিসেবে বিশ^ দরবারে প্রথম স্থান অধিকার করবে। আসুন, আমরা পরিবেশবান্ধব ঢাকা শহর গড়ে তুলি। এটি হোক তারুণ্যের স্লোগান।

লেখক : পরিবেশ কর্মী ও ব্যাংক কর্মকর্তা

প্যানেল

×