
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে আসতে যাচ্ছে, যা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্যও একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে। বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিমসটেক (বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিকের কোঅপারেশন) নেতৃত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্ভাব্য চেয়ারম্যান হিসেবে সামনে আসছেন। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে গন্য হতে পারে।
বিমসটেক গঠিত হয় ১৯৯৭ সালে ব্যাঙ্ককে, যার মূল উদ্দেশ্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। বর্তমান বিশ্বে আঞ্চলিক সংহতির গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে এবং বিমসটেক সেই লক্ষ্যে কাজ করছে। একে ঘিরে দেশগুলো বিভিন্ন দিক থেকে একে অপরের সাহায্য করতে এবং একত্রে নানা বিষয়ে এগিয়ে যেতে চায়। এর লক্ষ্য শুধু আঞ্চলিক শীর্ষ উন্নয়ন নয়, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী মঞ্চ তৈরি করা।
বিমসটেকের সদস্য দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, নেপাল ও ভুটান। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। এটি ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও অন্য দেশগুলোর সংযোগকারী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ বিমান, রেল, সড়ক ও নদী পরিবহনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করছে। ভারত বিমসটেকের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের প্রধান দাবিদার। এর আঞ্চলিক শক্তি ও অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি। মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও এটি ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উন্নয়ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রস্থল, যার অর্থনীতি প্রধানত বাণিজ্য এবং পর্যটন নির্ভর। থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনীতি এবং শিল্পের মূল কেন্দ্র, বিশেষ করে পর্যটন ও প্রযুক্তি খাতে। নেপাল ও ভুটান উচ্চভূমি রাষ্ট্র, যাদের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে সীমিত, কিন্তু তাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।
বিমসটেক দেশগুলো সম্মিলিতভাবে একটি বিশাল অর্থনৈতিক বাজার গঠন করেছে। বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১.৭ বিলিয়ন, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২২%। বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এই অঞ্চলের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির পরিচায়ক। বর্তমানে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের হার মাত্র ৭ শতাংশ, যা অঝঊঅঘ-এর তুলনায় অনেক কম (৩০ শতাংশ)। তবে এই হার বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রসার ঘটবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, যিনি ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক। তার নেতৃত্বগুণ এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক চিন্তাধারা বিমসটেককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। তার অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক ব্যবসায়িক মডেল এ অঞ্চলের উন্নয়নকে আরো একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে। তিনি সামাজিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাঁর সৃজনশীলতা ও প্রভাব বিমসটেকের প্রতিটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার নেতৃত্বে বিমসটেক লাভবান হতে পারে অর্থনৈতিক সংযোগ বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এবং সংঘবদ্ধ আঞ্চলিক নীতির মাধ্যমে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে, বিমসটেক অঞ্চলের ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলোর (ঝগঊং) উন্নয়ন ঘটাতে পারেন, যা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি কার্যকর দিকনির্দেশনা হতে পারে। সীমান্ত পেরিয়ে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা চালু হলে ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। বিমসটেক অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার এখনও ৩০ শতাংশ এর বেশি। ড. ইউনূসের মাইক্রোফাইন্যান্স মডেল এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তৈরি করা সম্ভব হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। এ ছাড়াও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পাবে। বিমসটেক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ডিজিটাল ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হলে উদ্যোক্তাদের জন্য বিশ্বব্যাপী বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। কৃষি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, যেখানে ড. ইউনূসের পরামর্শ এবং মডেল নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতি তৈরি করতে ড. ইউনূস কৌশলগত ভূমিকা রাখতে পারেন। তার সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব এই অঞ্চলের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল এবং কর্মক্ষম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যটন খাতের প্রসার বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিমসটেকের চেয়ারম্যানশিপ বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ (ঋউও) আকর্ষণের একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের প্রতি আগ্রহী হবে। বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান সংযোগ বৃদ্ধি করে বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ এ কাজে বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে পারবে। বিমসটেক অঞ্চলে পর্যটনের বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে এই অঞ্চলে পর্যটকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ মিলিয়ন, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে ভারতের প্রভাব, মিয়ানমারের অস্থিরতা এবং অর্থায়ন ও কাঠামোগত দুর্বলতা। ভারত বিমসটেকের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হওয়ায়, বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে কাজ করতে হবে। ভারতের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সামগ্রিক আঞ্চলিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে হবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রোহিঙ্গা সংকট বিমসটেকের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বিমসটেকের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য যথাযথ অর্থায়ন এবং প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নেতৃত্বে বিমসটেক একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে। ড. ইউনূসের মতো দূরদর্শী নেতার হাত ধরে সংস্থাটি একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
প্যানেল