
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণ হলো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক সহজলভ্য, টেকসই ও দামে কম হওয়ায় দৈনন্দিন জীবনে মানুষ এটা ব্যবহার করছে। কিন্তু প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশ ও আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আধুনিক জীবনযাত্রায় প্লাস্টিক দূষণ এক বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য পরিমাণে প্লাস্টিক পণ্য যেমন-বোতল, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিকের বাক্স, পিভিসি পাইপ, প্লাস্টিকের কাপ, অ্যাক্রিলিক প্লাস্টিক ইত্যাদি উৎপাদন করে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক বিস্তৃত। কিন্তু ব্যবহারের পর এসব প্লাস্টিককে পুকুর, নদী-নালা, ড্রেন, রাস্তাঘাটে ফেলে দেওয়া হয়। এসব প্লাস্টিক মাটিতে না মেশার কারণে বছরের পর বছর একই জায়গায় থেকে যায়। ফলে পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত হয়।
প্লাস্টিক হলো এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে যেমন সময় লাগে তেমনি কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতেও সময় লাগে। তাই প্লাস্টিক দূষণ হচ্ছে পরিবেশের জন্য নিরাপদ নয়। প্লাস্টিক দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় জলজ পরিবেশের। পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ফেলে দেওয়ায় এটি যেমন পানিকে দূষিত করে ঠিক তেমনি তা জলজ প্রাণীদেরও ক্ষতি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় এক লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিক খাওয়ার ফলে মারা যায়। এই জলজ প্রাণীগুলো প্লাস্টিককে খাবার মনে করে খেয়ে ফেলার কারণে এদের প্রজননক্ষমতা হ্রাস পায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত হয়। যেহেতু প্লাস্টিক মাটিতে মিশে না তাই ব্যবহৃত প্লাস্টিক মাটিতে ফেলে দেওয়া হলে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলো মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে। এছাড়াও প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া হলে তা ড্রেনের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। প্লাস্টিক কেবল মাটি ও পানিই দূষণ করে না বরং মানবজীবনেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকের ভেতরে থাকা ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ (৫ মিলিমিটারের কম প্লাস্টিক কণা) নামক কণাগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, স্নায়ুতন্ত্রের রোগসহ আরও বিভিন্ন রকমের সমস্যার সৃষ্টি করে। ডব্লিউএইচওর (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন) গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু জন্মগ্রহণের আগেই মাইক্রোপ্লাস্টিক তার শরীরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। আবার প্লাস্টিককে পোড়ানো হলে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস মানুষের শরীরের ভেতরে ঢুকে শ্বসনতন্ত্রের ক্ষতি করে। আবার এই বিষাক্ত গ্যাস বায়ু দূষণেরও অন্যতম কারণ।
প্লাস্টিক দূষণ প্রতিহত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে জাতিসংঘের প্লাস্টিক চুক্তি তৈরির কাজ চলমান রয়েছে এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়াও ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। প্রথম দিকে উদ্যোগটি বাস্তবায়নে ঘাটতি দেখা গেলেও বর্তমানে এর কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয় যার মধ্যে ৩৬ শতাংশই হলো একবার ব্যবহারযোগ্য। ইউএনইপির (ইউনাইটেড ন্যাশনস্ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম) তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং বাকি ৭৯ শতাংশ সরাসরি জমা হয় মাটি ও পানিতে। প্রতি বছর প্লাস্টিক দূষণের কারণে মৎস্য, পরিবহন আর পর্যটন খাতে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। প্লাস্টিক পরিবেশকে প্রতিনিয়ত দূষিত করে চলেছে যার অন্যতম একটি কারণ হলো প্লাস্টিক বায়োডিগ্রেডেবল নয় অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভাঙে না।সমুদ্র উপকূলবর্তী বেশ কিছু এলাকা প্লাস্টিক দূষণের কারণে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে। একসময় প্লাস্টিককে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে প্লাস্টিক-ই হয়ে উঠেছে ধ্বংসের কারণ। প্লাস্টিক দূষণের কোনো সীমা নেই কারণ এটি পচনযোগ্য নয়।
প্লাস্টিকের মধ্যেও কিছু ধরণ রয়েছে যেগুলো আবার পরিবেশবান্ধব। নাইলন, পলিকার্বোনেট, পলিইথার ইথার কেটোনসহ এসব উন্নত মানের প্লাস্টিকগুলো তাপমাত্রা সহনশীল, উচ্চশক্তিসম্পন্ন ও দীর্ঘস্থায়ী। উন্নত মানের প্লাস্টিক অনেকটা টেকসই হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা যায় এবং অতিরিক্ত বর্জ্য উৎপাদন কমাতেও ভূমিকা রাখে। তবে উন্নত মানের প্লাস্টিক যে সবসময় পরিবেশবান্ধব তা নয়। উন্নত মানের প্লাস্টিক উৎপাদনের সময় বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আবার এই ধরনের প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করাও কষ্টসাধ্য কারণ এর গঠন কিছুটা জটিল হয়।
মূলত মানুষের অসচেতনতাই হলো প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ। মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে ফেলে দেয়। আর সেই প্লাস্টিক একই জায়গায় দীর্ঘদিন যাবৎ পড়ে থাকার কারণে পরিবেশের প্রধান উপাদান, যেমন-মাটি, পানি, বায়ুকে বিভিন্নভাবে দূষিত করে। এছাড়াও প্লাস্টিক ভাঙনের ফলে এক ধরনের গ্যাস উৎপন্ন হয় যা মিথেন গ্যাস নামে পরিচিত। মিথেন হলো এক ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস। এই গ্রিনহাউস গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণায়নে প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই প্লাস্টিক দূষণ নিরসনে জনসচেতনতাই হলো মূল পদক্ষেপ। প্লাস্টিক দূষণ শুধু পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর নয় এমনকি এটি মানুষের অস্তিত্বকেও হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কঠোর আইনব্যবস্থা, সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ নিরসন করা সম্ভব। যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবহার এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হয় তাহলেই বিশ্বব্যাপী এই প্লাস্টিক দূষণের সমস্যাটিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল