
বাংলাদেশের ইতিহাসজুড়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ছোঁয়া প্রতিবারই দেশের পরিবর্তিত সমাজ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। দেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই রাজনৈতিক পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও শাসনের ধারার পুনর্গঠন প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট। এই পরিবর্তনগুলো শুধু বয়স্ক প্রজন্ম নয়, বরং তরুণ প্রজন্মের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তরুণরা, যারা সমাজের আগামীর প্রতিনিধি, তারা রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য নিজেদের রীতিমতো এগিয়ে এসেছে। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও উদ্দীপনা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের আকাক্সক্ষা ও নতুন ভাবনার প্রবর্তন দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশের রাজনৈতিক জগতে বিদ্যমান বর্ধিত লোকতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ এবং পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতা তরুণদের জন্য একদিকে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। অপরদিকে কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে আমরা লক্ষ্য করেছি কিভাবে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক সচেতনতা লাভ করেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠন থেকে উদ্ভূত তরুণ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও রাস্তায় সরাসরি আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তনের আবেদন উঠে এসেছে। ২০২৪ সালে তরুণ ছাত্র আন্দোলন এবং বিদ্রোহে প্রদর্শিত সাহসিকতা শুধু বিগত সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থাকে দমন করে নতুন চিন্তাভাবনার সূচনা করেছে।
গত কয়েক বছরে টেকসই শিক্ষা, চাকরির সুযোগ ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে তরুণরা তাদের অভিযোগ তুলেছে। শিখন-সংলাপ থেকে শুরু করে বৃহৎ জনসমাবেশ ও গণ-আন্দোলন, তরুণরা আজ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, যেখানে ছাত্ররা সততা ও যোগ্যতার আদর্শ নিয়ে এক বিরাট আন্দোলন চালিয়েছে, তা পুরো দেশের রাজনৈতিক চিত্র পরিবর্তনের এক নতুন অধ্যায় খুলে দেয়। এ আন্দোলনে তরুণদের নেতৃত্ব ও সংগঠিত দক্ষতা নতুন একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা তৈরি করার প্রেরণা জোগায়, যা পরবর্তী সময়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আকার নিয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া প্রায়ই জটিল ও দ্বন্দ্বপূর্ণ, যেখানে গঠনতন্ত্র, নির্বাচনীবিধি ও শাসন কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। তরুণরা এখানেই একটি নতুন চিন্তাভাবনার সূত্রপাত ঘটায়। তাদের কল্পনা, উদ্ভাবনী চিন্তা ও উদ্দীপনামূলক কর্মকাণ্ড রাজনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে সহায়ক হতে পারে। নতুন রাজনৈতিক দল ও এর প্রভাব, সম্প্রতি তরুণ নেতা ও ছাত্র আন্দোলনের দ্বারা প্রেরণা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, যা পুরানো ঐতিহ্যগত দুই প্রধান দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) বিরোধে তরুণদের পক্ষ থেকে পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছে।
তরুণ প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা : প্রত্যেক ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ থাকে। তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত আদর্শ, দুর্নীতি, অধিকারসংক্রান্ত অভাব ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যৌক্তিক অংশগ্রহণের অভাব থেকে উদ্ভূত হয়।
উদ্যোগ, উদ্দীপনা ও বাধাÑ
দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অক্ষমতা : রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী দুর্নীতি ও ক্ষমতার একাধিকারী প্রথা তরুণদের পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরনো আদর্শে আটকা পড়ে থাকে, যা নতুন ধারাকে অনুমোদন করে না। তরুণ নেতাগোষ্ঠী বলতে পারে, ‘আমরা শুধু একটি নতুন দিক নয়, বরং একটি নতুন প্রক্রিয়া চাই, যা স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল ও সমান অংশগ্রহণমূলক হবে।’
প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামোর বাধা : বাংলাদেশের রাজনৈতিক গঠন দীর্ঘদিন ধরে দুটি মূল দলের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। এই প্রথাগত কাঠামো তরুণদের জন্য রাজনৈতিক স্থান সৃষ্টিতে অবরোধ তৈরি করে। তরুণরা যদি নিজেদের নতুন নীতি ও আদর্শ নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে এই প্রথাগত কাঠামো থেকে ছাড়িয়ে উঠতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। তবে, নতুন গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করে তরুণরা এক নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার সুযোগও নিজেদের কাছে দেখতে পাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও বেকারত্ব : দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব একটি বৃহৎ সমস্যা। গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সঙ্গে, নতুন চাকরি সৃষ্টির উদ্যোগ ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা তরুণদের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয়তা। তরুণদের নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে, সরকার ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চাপ : তরুণ প্রজন্মের ওপর সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর প্রথাগত চাপ থাকলেও তারা যদি স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক ধারণা নিয়ে কাজ করতে চায়, তাহলে এর জন্য উপযুক্ত সামাজিক সমর্থন ও নেতিবাচক পক্ষের দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে হয়।
সম্ভাবনার দিক তবে তরুণদের সম্ভাবনা অশেষ। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেমনÑ সোশ্যাল মিডিয়া রাজনৈতিক বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তারা শাসনের মুখ্য ধারায় নতুনত্ব আনার পাশাপাশি বিশ্বায়নের ধারায় দেশের উন্নয়নে নতুন উদ্দীপনা যোগ করতে পারে।
গণতান্ত্রিক সংস্কারের আহ্বান : বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব ও উন্নয়নের জন্য তরুণদের ভূমিকা অপরিহার্য। তরুণরা গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সামাজিক নীতি সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে।
নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব নতুন রাজনৈতিক দলের উদ্ভব, যেখানে তরুণ নেতা ও সমাজের উদ্দীপনা মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, তা পুরোনো রাজনৈতিক ধাঁচ ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি শক্তিশালী উদ্যোগ হতে পারে। যেখানে নির্বাচনের প্রক্রিয়া, সংবিধানের নীতিমালা ও প্রশাসনিক কাঠামো এক নতুন দিশা পেতে পারে। তরুণ প্রজন্ম একদিকে সমাজের উদ্দীপনা আর অন্যদিকে রাজনৈতিক আচার-ব্যবস্থার নবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
তরুণদের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সংস্কার। সরকার ও প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান দুর্নীতি, কুপ্রথা ও অধিকারসীমার পুনর্গঠন তরুণদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে সমর্থন লাভের মাধ্যমে তরুণরা দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বব্যাপী তরুণ আন্দোলনের উদাহরণ যেমন পশ্চিমা দেশগুলোতে ও লাতিন আমেরিকায় দেখা যায়, সেগুলো বাংলাদেশের জন্যও প্রেরণাদায়ক হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন ও প্রতিক্রিয়া : বিদেশী গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমনÑ জাতিসংঘ, ইউএস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তরুণদের আন্দোলনকে সমর্থন ও প্রেরণা জোগাতে কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উদাহরণগুলো যেমনÑ ‘আরব বসন্ত’ বা আমেরিকার প্রজন্মের আন্দোলন, এসব থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের তরুণদের নতুন দিশা দেখায়। তরুণরা এই আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জানতে পেরেছে কিভাবে তারা নিজেদের আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক সংস্কার : আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা মনে করে। তরুণরা দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে নতুন ধারণা ও প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের উন্নয়নের নতুন পথ খুলতে সাহায্য করতে পারে। এসব সহযোগিতা তরুণদের মধ্যে উদ্যম ও বিশ্বস্ততা বাড়ায়, যার ফলস্বরূপ তারা নিজেরাই নেতৃত্বের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ও তরুণ প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও আদর্শের প্রভাবে তরুণরা শুধু সমাজের মেরুদণ্ড নয়, বরং দেশের আগামী দিনগুলোর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তরুণরা নিজেরা যদি শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং সুসংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমে শাসনের নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তবে গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারে এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। তারা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের আধুনিকীকরণে সহায়তা করতে পারে। একইসঙ্গে, পুরানো রাজনীতির জটিলতা ও দুর্নীতির মোকাবিলায় তরুণদের জন্য সংকটও ততোধিক গুরুতর। তবে এই সংকটই তাদের নতুন পথের সন্ধান করতে প্রেরণা জোগাবে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য তরুণদের সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম যেখানে শাসনের গতিশীলতা ও নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে, তা দেশের আগামী দিনের নিরাপত্তা, সুখশান্তি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। তরুণ প্রজন্ম যদি নতুন নীতি ও শাসনের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ হয়তো এক নতুন ও উদ্দীপনাময় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন মর্যাদা ও উন্নয়নের সুযোগ সমানভাবে বণ্টিত হবে।