
বর্তমান অত্যাধুনিক যুগে জীবন চলার পথে যে কোনো কাজেই এগিয়ে যান না কেন, আঙুলের ছাপ ছাড়া প্রশ্নবিদ্ধসহ প্রতিবন্ধকতায় সম্মুখীন হবেন। আপনিই যে আপনি, তা কেবল আঙুলের ছাপেই শনাক্তপূর্বক বলে দেবে। মজার ব্যাপার হলো যে, আপনার আঙুলের ছাপ শুধুই আপনার। সারা পৃথিবীতে প্রায় সারে আট শত কোটি মানুষের ছাপের সঙ্গে কোনো মিল হবে না। শুধু তাই নয়, সৃষ্টির গোড়া থেকে শুরু করে যত মানুষ এই ধরায় এসেছেন এবং পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত যত মানুষ আসবেন, কারও আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিল তথা এক হবে না। আঙুলের এই ব্যতিক্রম ছাপের ব্যাপারে এখন বিজ্ঞানীরা জোর গলায় বললেও এ কথাটি ১৪ শত বছর আগেই পবিত্র কোরআন শরীফের সূরা ক্বিয়ামাহ (মক্কায় অবতীর্ণ)’তে উল্লেখ করা হয়েছে। যেভাবেই বলি না কেন, আঙুলের ছাপ আল্লাহ তা’লার এক মহা বিস্ময়কর সৃষ্টি।
বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান কি বলেছে জানেন? এ ব্যাপারে বিজ্ঞান বলে যে, গর্ভ অবস্থায় যখন ভ্রুনের মাত্র ১০ সপ্তাহ বয়স, তখন তার আঙুলের ছাপ গঠিত হয়। আর সেটা সারাজীবন একই থাকে; পরিবর্তন হয় না। কোনো দুই ব্যক্তির আঙুলের ছাপ কখনই এক হয় না। এমনকি জমজ ভাই-বোনদের ক্ষেত্রেও নয়। কিন্তু কেন? এর কারণ মায়ের গর্ভে প্রতিটি শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ একেবারেই আলাদা হয়; যা তাদের আঙুলের ছাপের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া আপনার আঙুলের ছাপে আরও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, আঙুলের ছাপ কেবল আপনাকে শনাক্ত করে, তাই নয়। একইসঙ্গে আপনার জি¦নগত দিক দিয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য বহন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের আঙুলের ছাপ আঁকাবাঁকা, তাদের বহুমূত্র ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি থাকে। এই রকম আরও নানা রোগের চিহ্ন বহন করে থাকে, যা এখনো আছে গবেষণার পর্যায়ে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, এক সময় শুধু অপরাধীকে ধরতে আঙুলের ছাপ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে নাগরিকদের পরিচয়ের জন্য; যেমন- আইডেন্টেটি কার্ড ও পার্সপোট বইসহ বায়োমেট্রিক্স তথ্য সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে এই ছাপ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও বাংলাদেশে মোবাইল সিম কিনতে আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমনকি, অনেক অফিসে ও ডিজিটাল প্লাটফর্মে পাসওয়ার্ডের পরিবর্তে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। আঙুলের ছাপের বিষয়টি আল্লাহর কুদরতের এক অকাট্য প্রমাণ বৈ কিছু নয়। পবিত্র কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই আল্লাহ তা’লা এই সৃষ্টির কথা বলেছিলেন। এটাই প্রমাণ করে যে, কোরআন কখনো মানুষের লেখা নয়; বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ১৬৮৪ সালে সর্বপ্রথম ইংলিশ ফিজিশিয়ান, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং অনুবীক্ষণ যন্ত্রবিদ নিহোমিয়া গ্রিউ করতল ও আঙুলের ছাপের রহস্যের সংযোগ সূত্রের ধারণার উত্থাপন করেন। ১৬৮৪ সালের আগে ফিঙ্গার প্রিন্ট সম্পর্কে আর কোনো বিজ্ঞানীর আলোকপাতের কথা পাওয়া যায় না। পরবর্তীতে দীর্ঘ বিরতির পর ১৮০০ সালের পর ফিঙ্গার প্রিন্ট পুনরায় জোরভাবে বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এক্ষেত্রে তাঁরা বিভিন্ন আঙ্গিকে গুরুত্ব দেন। এ সকল বিজ্ঞানীর মধ্য উল্লেখযোগ্য হলেন, জেন জিন্সেন, সৈয়দ মুহাম্মাদ কাজী আজিজুল হক (খুলনা) ও ব্রিটিশ কর্মকর্তা এওয়ার্ড হেনরি। অবশ্য ১৬৮৫ সালে ডাচ ফিজিসিয়ান গোভার্ড বিডলো এবং ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মারসিলো বিডলো এনাটমির ওপর বই প্রকাশ করে ফিঙ্গার প্রিন্টের ইউনিক গঠনের ওপর নানা বিষয় তুলে ধরেন। প্রকাশ থাকে যে,খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে ব্যবসায়িক কাজে ছোট ছোট শুকনো কাঁদার খণ্ডে ব্যাবিলিয়ানদের আঙুলের ছাপ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। ১৮৯১ সালে আর্জেন্টিনার হুয়ান ভুসেটিস অপরাধী ধরার পদ্ধতি আবিষ্কার করার মাধ্যমে আধুনিক যুগের আঙুলের ছাপের ব্যবহার শুরু করেন।
কথা প্রসঙ্গে আবার আল কোরআনের কথাই ফিরে আসি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, আল্লাহ তা’লা যখন কোরআনে বারবার বিচার দিবস ও পুনরুত্থানের কথা বলেছেন, তখন কাফিররা এই বলে হাসাহাসি করতো যে পচা গলা হাড়গুলোকে কীভাবে একত্রিত করা যাবে? একজনের অস্থির সঙ্গে অন্যজনের গুলো কি বদল হবে না? এ ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন প্রতিউত্তরে বলেছেন যে, ‘মানুষ কি মনে করে যে আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? বরং আমি তার অঙ্গুলিগুলোর ডগা পর্যন্ত সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম’ (আল কিয়ামাহ, আয়াত ৩-৪)। বস্তুত এখানে মহান রব ফিঙ্গার প্রিন্টের সক্রিয়তার ওপর ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর আল্লাহ তা’লা কেবল অস্থি-মাংস দিয়েই উত্থিত করবেন না; বরং এমন নিখুঁতভাবে মানুষকে পুনরায় জীবিত করবেন, যেমন জীবদ্দশায় তার আঙুলের শুক্ষ রেখা পর্যন্ত সুবিন্যস্ত ছিল। এখানে এটাই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পুনরুত্থানে কত নিখুঁতভাবে পুনরায় মানুষকে হুবহু অবয়ব দেওয়া হবে।
যে ভাবেই বলি না কেন, ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রকারান্তরে ডাটা ব্যাংক বলে অভিহিত। কেননা, জি¦নের মধ্য সন্নিবেশিত প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য, শুধু শারীরিক গঠনই নয়, বরং চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য পর্যন্ত আঙুলের ছাপে এনকোড করা থাকে। তাই আল্লাহ এখানে কাফিরদের জবাব ও জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন দিয়েছেন যে, শুধু আঙুলের ডগার প্রিন্ট দিয়ে যদি একটি মানুষের সম্যক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব হয়, তবে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের অস্থি দিয়ে পুনর্বিন্যস্ত করা কোনো ব্যাপারই নয়।
অনেকেই বায়োমেট্রিকস বায়োলজিক্যাল ডাটা পরিমাপ এবং বিশ্লেষণ করার প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত আছেন। এখানে গ্রিক শব্দ ইওঙ, যা অর্থ জীবন বা প্রাণ এবং গবঃৎরপ হলো পরিমাপ করা। মূলত বায়োমেট্রিকস এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে কোনো ব্যক্তির গঠনগত এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে অদ্বিতীয়ভাবে চিহ্নিত বা শনাক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যাপারে আগেই উল্লেখ করেছি যে, একজনের অঙুলের ছাপ বা টিপসই অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে মিল নেই। এটি মাথায় রেখে প্রথমেই আঙুলের ছাপ ডাটাবেইসে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিডারের মাধ্যমে আঙ্গুলে ছাপ ইনপুট নিয়ে ডাটাবেইসে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপের সঙ্গে তুলনাপূর্বক যে কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায়। আসলে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিডার হচ্ছে বহু ব্যবহৃত একটি বায়োমেট্রিক ডিভাইস, যার সাহায্যে মানুষের আঙুলে ছাপ বা টিপসইগুলো ইনপুট হিসেবে গ্রহণ করে, তা আগে থেকে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ বা টিপসইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। তবে যাঁরা দৈহিকভাবে আঙুলের কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে রেখাগুলো কিছুটা মুছে গেলে, এই পরীক্ষায় জটিলতার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
লেখক : গবেষক, অর্থনীতিবিদ
[email protected]/www.goonijon.com
প্যানেল