ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২

একটি আশঙ্কা-২০৫০

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়

বাহলুল আলম

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১৯ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:১২, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়

বিশ্ববাসীর কাছে এটা নতুন কোনো ধারণা নয় যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন। জলবায়ুর এই নেতিবাচক পরিবর্তন মানব সভ্যতার সামনে এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর চরম আঘাত হানতে যাচ্ছে, যা ইতোমধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশে পরিবর্তনই আনছে না, এটি মানব জীবন, খাদ্য উৎপাদন, পানীয় জল সরবরাহ, স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি সবকিছুই প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো-

Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর 6th Assessment Report অনুযায়ী, ২১ শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গড়ে ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ২-৩ মি.মি. হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে (Bangladesh Meteorological Department)। উপকূলীয় ১৯টি জেলার মধ্যে প্রায় ১০টি জেলা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার বাড়লে প্রায় ১৭% জমি এবং ৩০ মিলিয়ন মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে (World Bank, 2020) Soil Resource Development Institute (SRDI)  অনুসারে, গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৬%। International Organization for Migration (IOM) : ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৫-২ কোটির বেশি মানুষ তাদের বসতি হারাতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলে। তাদের বলা হচ্ছে  climate refugees, যাদের অনেকেই শহরমুখী হয়ে চরম দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।  Sundarbans mangrove forestজলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবের শিকার। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের অভাবে লোনা পানি ঢুকে মিঠা পানির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
সম্ভাব্য ক্ষতি : মৎস্য শিল্পের ধ্বংসে উপকূলীয় জেলেরা জীবিকা হারাচ্ছেন। সুন্দরবনের ক্ষয়ে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষার প্রাকৃতিক ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল (যেমন- সুন্দরবন) রয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিপন্ন হতে পারে। বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনের ৪০% অঞ্চল আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিলীন হতে পারে। যা বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশ্ব প্রকৃতি তহবিল (WWF) এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সুন্দরবনে যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল, তেমনি এটি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। যা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানবিক ও পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি করবে। পানিবাহিত রোগ (ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ) বাড়ছে। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি দেখা দেয়।
Internal Displacement Monitoring Centre (IDMC) অনুযায়ী, ২০২২ সালে জলবায়ুজনিত কারণে বাংলাদেশে ৭ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শহরমুখী অভিবাসন বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বিভাগীয় শহরে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। বস্তি ও সামাজিক অস্থিরতা তথা অপরাধ, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়েই যাবে। মানসিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে যারা বাস্তুচ্যুত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বেই বিশেষ করে জলবাহিত রোগ এবং তাপমাত্রার কারণে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের প্রবণতা পরিবর্তন হলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং কলেরা রোগের বিস্তার বাড়বে। স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে।
লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমি অনাবাদি হয়ে পড়বে। ধান, গম, সবজি, পাটসহ খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩০-৪০% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।  গবাদি পশু ও খামারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পানির সংকট তীব্র হবে, লবণাক্ততা ভূগর্ভস্থ ও পৃষ্ঠজল উভয়েই আক্রান্ত করবে, বিশুদ্ধ পানির অভাবে জলবাহিত রোগ ও অপুষ্টি ব্যাপকভাবে ছড়াতে পারে। মৎস্য ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় নদী ও মোহনার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। চিংড়ি, ইলিশ ও অন্যান্য মাছের প্রজনন হ্রাস পেতে পারে। যার ফলে জীবিকা হারাবে লাখো মানুষ।
করণীয় হিসেবে উপকূলীয় এলাকায় গাছ লাগানো, বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বন সম্প্রসারণ ও সুরক্ষা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। বাড়ির চারপাশে নারকেল, তাল, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি গাছ রোপণ করা। চাষাবাদের জন্য লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান, গম বা সবজির জাত নির্বাচন করা।  লবণ সহনশীল কৃষি গবেষণা ও বীজ সরবরাহে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার দক্ষ করার জন্য বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ। শুধু কৃষির ওপর নির্ভর না করে হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্যচাষ (বিশেষ করে ফ্লক পদ্ধতিতে), হস্তশিল্প বা ক্ষুদ্র ব্যবসায় উৎসাহ দেওয়া। নারীদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে সেলাই, কুটির শিল্প, এবং ছোটখাটো উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
উঁচু মাচা বা প্ল্যাটফর্মের ওপর ঘর নির্মাণ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধে উপযোগী স্থাপত্য গঠন করা। স্থানীয় সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে সঠিকভাবে যাতায়াত নিশ্চিত করা। পরিবারভিত্তিক জরুরি পরিকল্পনা তৈরি (প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ওষুধ, শুকনো খাবার সংরক্ষণ)। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা। স্কুল ও কমিউনিটিতে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা। সরকার বা এনজিও-এর মাধ্যমে বিনামূল্যে চারা, প্রশিক্ষণ, টেকসই কৃষি সরঞ্জাম গ্রহণ। উপকূলীয় জেলায় মিষ্টি পানির রিজার্ভার নির্মাণ। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ঘরে ঘরে হারভেস্টিং সিস্টেম চালু করা। দুর্যোগে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের সরকারি সুযোগ সম্পর্কে অবগত থাকা। আগাম ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা ও এসএমএস সতর্কবার্তা প্রযুক্তি আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করা।
জলবায়ুর কারণে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর জন্য গৃহনির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প (যেমন- আশ্রয়ণ প্রকল্প) আরও সম্প্রসারণ। কর্মসংস্থান ও শিক্ষা নিশ্চিত করে সামাজিকভাবে পুনঃঅন্তর্ভুক্তি। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল (ঈচচ) শক্তিশালী করা। উন্নত দেশগুলো থেকে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ (পষরসধঃব ভরহধহপব) সংগ্রহে সক্রিয় কূটনীতি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ‘ষড়ংং ধহফ ফধসধমব’ অর্থায়ন নিশ্চিত করা। জাতীয় জলবায়ু ফান্ড গঠন করে উপকূলীয় উন্নয়নে ব্যবহার। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ঘঅচ) ও জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (ইঈঈঝঅচ) কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বহু-খাতভিত্তিক সমন্বিত নীতি গ্রহণ। ‘আগামী প্রজন্মের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের মানসিকতা, অভ্যাস ও নীতিতে পরিবর্তন আনতে না পারলে ২০৫০ সালে উপকূল নয়, পুরো বাংলাদেশই বিপদের মুখে পড়তে হতে পারে।

লেখক : উপকূলবাসী উন্নয়ন কর্মী

প্যানেল

×