
বুড়িগঙ্গা নদীর বর্তমান বেহালদশা ঢাকাবাসী স্বাভাবিক একটি বিষয় হিসেবেই গ্রহণ করে নিয়েছে। প্রতিদিন ৬০,০০০ ঘনমিটারের বেশি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদীতে (The Business Standard)। মূলত সতেরো শতকে আজকের এই ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে প্রবাহিত হয়েছিল এবং সেই থেকে এই নদীকে কেন্দ্র করে শহরটির মূল বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। এটি শহরের প্রধান পানি সরবরাহ, নিষ্কাশন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা উত্তরের দিকে দ্রুত প্রসারিত হওয়ার কারণে নদীর পাশে জনসংখ্যার চাপ বেড়ে উদ্ভূত নানা কারণে নদীটির বর্তমানে এই দুরবস্থা (Buriganga Riverkeeper)। তবে মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গাকে বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি, উপযুক্ত নীতিমালা এবং সঠিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের মাধ্যমে আবারও পুনর্জীবিত করা সম্ভব। প্রধান যেসব কারণ একত্রিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে তীব্র দূষণে সৃষ্টি করে পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে সেগুলো হলো-
শিল্প দূষণ
হাজারিবাগে ২৪০টির বেশি ট্যানারি প্রতিদিন ৭.৭ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগাঙ্গায় ফেলে, যার মধ্যে ক্রোমিয়াম এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে (Buriganga Riverkeeper)। সেই সঙ্গে প্রায় ৫০০-৭০০ টেক্সটাইল এবং রং কারখানা থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন- রং, লবণ, ব্লিচ প্রভৃতি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয়, যা জলজ প্রাণিদের মধ্যে অক্সিজেনের চাহিদা এবং রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা বাড়িয়ে তোলে (Environmental Research Communications)। সম্প্রতি হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরিত হলেও বন্ধ হয়নি দূষণ প্রক্রিয়া।
কঠিন বর্জ্য ফেলা
শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪,৫০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার অধিকাংশ বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় (IJIRD)। যেসব প্লাস্টিক ধ্বংস করা যায় না, যেমন- গ্লাভস, মাস্ক প্রভৃতি নদীর তলদেশে জমা হয়ে স্থবির তলদেশ সৃষ্টি করেছে।
দখল
নদী তীরবর্তী এলাকায় অবৈধ দখল যেমন- ভবন নির্মাণ এবং ল্যান্ডফিল স্থাপনে নদী আরও সংকুচিত, এর প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং দূষণ বাড়ছে। (Scientific Research) বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ ইতোমধ্যেই মারাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছে। জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেমন- শ্বাসকষ্ট, ত্বক ও পানিবাহিত রোগের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে যাদের জীবিকা এই নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেই সঙ্গে এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে যাদের জীবন তাদেরও। নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বন্যপ্রাণী এবং জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে এবং সংখ্যাও অনেক কমে গিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। নদীতে বাণিজ্য, পর্যটন এবং জলপথে পরিবহন নদীর এই অবস্থার জন্য ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। যদি আমরা এই সংকট উপেক্ষা করতে থাকি, তবে বুড়িগঙ্গা পুরোপুরি জীববৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়বে। এর ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকা আরও বিপর্যস্ত হবে।
নিম্নলিখিত কয়েকটি পদ্ধতি প্রয়োগ করে বুড়িগঙ্গার বর্তমান অবস্থা থেকে উপযুক্তভাবে উত্তরণ সম্ভব-
বুড়িগঙ্গার ভেতরে থেকে (ইন সিটু) : বায়ো-রেমিডিয়েশন-
এ পদ্ধতিতে অণুজীব ব্যবহার করে নদীর পানিতে দূষণকারী উপাদানগুলো পরিষ্কার করা হয়। এসব অণুজীব জৈব দূষণকারী পদার্থগুলো ভেঙে ফেলে। যার ফলে পরিবেশের ওপর তাদের ক্ষতিকর প্রভাব কমে যায়।
ফাইটো-রেমিডিয়েশন
এটি একটি উদ্ভিদভিত্তিক সমাধান, যেখানে বিশেষ কিছু উদ্ভিদ যেমন- কচুরিপানা বা এ জাতীয় জলজ উদ্ভিদ ভারী ধাতু এবং অন্যান্য দূষণকারী পদার্থ পানি থেকে শোষণ করে। উদ্ভিদের শিকড়গুলো পানির মধ্যে ভাসমান থেকে বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে নদীর পানি পরিষ্কার হয়।
ভাসমান জলাভূমি
ভাসমান জলাভূমির শিকড় পানির মধ্যে ঝুলে থাকে এবং পানি থেকে বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে। এই পদ্ধতি পানির গুণমান উন্নত করে এবং বন্যপ্রাণীর জন্য বাসস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
বাতান্বয়ন
ঝর্ণা বা পাম্প ব্যবহার করে পানির অক্সিজেন স্তর পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতি জলজ জীবনের জন্য সহায়ক এবং নদীর স্ব-পরিশোধন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
বুড়িগঙ্গার বাইরে থেকে (এক্স সিটু) :সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (STP)-
কেন্দ্রীকৃত এবং বিকেন্দ্রীকৃত ঝঞচ ব্যবহার করে নদীতে প্রবাহিত হওয়ার আগে বর্জ্য পরিশোধন করা যেতে পারে। কেন্দ্রীকৃত ইউনিটগুলো বড় এলাকা থেকে সুয়ারেজ পরিশোধন করবে। অন্যদিকে বিকেন্দ্রীকৃত ইউনিটগুলো ছোট, স্থানীয় জনসাধারণের জন্য কাজ করে দূষণ রোধ করবে।
নির্মিত জলাভূমি
এগুলো নদীর পাশে তৈরি করে বর্জ্য পানি প্রাকৃতিকভাবে বিশোধনের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এই পদ্ধতি পানি পরিশোধন করতে সাহায্য করে এবং নদীতে প্রবাহিত হওয়ার আগে বর্জ্য পরিষ্কার হয়।
মেমব্রেন ফিলট্রেশন এবং ইলেকট্রোকোয়াগুলেশন :
শিল্প অঞ্চলগুলোর জন্য মেমব্রেন ফিলট্রেশন এবং ইলেকট্রোকোয়াগুলেশনের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। পদ্ধতিগুলো কার্যকরভাবে সূক্ষ্ম দূষণকারী বস্তু এবং ভারী ধাতু অপসারণ করতে সাহায্য করে।
যান্ত্রিক পদ্ধতি : ফ্লোটিং বুম এবং স্কিমার্স-
এসব যন্ত্র নদীর পৃষ্ঠ থেকে প্লাস্টিক এবং অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ করতে সাহায্য করে। ফ্লোটিং বুম আবর্জনা আটকে রাখে আর স্কিমার্স তা অপসারণ করে নদীকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এখানে আলোকপাত করা প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত পদ্ধতিগুলোকে সমন্বিত করে একটি ব্যবস্থা তৈরি করা হবে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। তাহলে আমরা বুড়িগঙ্গা নদীকে দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারব।
বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষার্থে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তার মধ্যে আছে বাংলাদেশ পানি আইন- ২০১৩ অনুযায়ী আইন কার্যকর করা। নদীর তীর থেকে শিল্প কারখানাগুলো স্থানান্তরিত করা উচিত, যেখানে কার্যকর ETP (এফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন করা হবে। দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারকে স্যাটেলাইট এবং জিআইএস মনিটরিং ব্যবহার করে বাস্তব অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। নদী রক্ষায় বাফার অঞ্চল এবং ইকো-পার্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সফলতা নিশ্চিত করতে সামগ্রিকভাবে পদক্ষেপগুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
একটি বটম-আপ মডেল তৈরিও অপরিহার্য। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং তরুণ সমাজের সচেতনা বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের কার্যক্রম এই মডেলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এনজিওগুলো স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নিতে পারে। স্থানীয় জনসাধারণকে বায়ো-রেমিডিয়েশন সাইটগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গণমাধ্যমকেও বিষয়টির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। মূল সমস্যাগুলোকে তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যান্য স্থানের সফল কাহিনী তুলে ধরতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বুড়িগঙ্গার এ অবস্থা কেবল একটি পরিবেশগত সংকট নয়, বরং নৈতিক সংকটও। বুড়িগঙ্গাকে এভাবে ফেলে রেখে আমরা আমাদের নিজেদের দায়িত্বকে অবহেলা করছি। বর্তমান সময়ই হচ্ছে সঠিক সময়, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে নতুনভাবে এই নদীকে পুনরুর্জ্জীবিত করার। এর পাশাপাশি প্রয়োজন কঠোর প্রশাসনিক তদারকি। এ দুই মিলিয়ে আমরা নদীটিকে অতীতের সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারি। নাগরিকদের বুড়িগঙ্গার গুরুত্ব উপলব্ধিতে এনে সচতেন হয়ে উচিত সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। নদী রক্ষার বিবিধ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা, হোক সেটা বাস্তবে বা ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
আমরা যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসি, ঢাকার হৃদয় আবারও স্পন্দিত হবে। এর ওপর দিয়ে বয়ে যাবে নতুন এক নদীর প্রবাহ, যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কল্যাণসাধন হতে থাকবে। তাই এখনই সময় সবার সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার।
লেখক : গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটিং সায়েন্স মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত