
‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’- এটা কোনো শিশু দিবসের প্রতিবাদ্য বিষয় ছিল। কিন্তু আমরা কি সেটা বজায় রাখতে পারছি? পারছি না। শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। শিশুরাই আমাদের সমাজকে পরিবর্তন করতে পারবে। শিশুদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কারণ, শিশুরা একদিন আমাদের দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তারাই আগামী দিনের সমাজ ও বিশ্ব গড়বে। কিন্তু সম্প্রতি এক দুর্ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে আহত করেছে। দুর্ঘটনাটি গাজীপুরের টঙ্গীতে দুই ভাইবোনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার ঘটনা। যেখানে একটি ফ্ল্যাট থেকে এই দুই শিশুর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিষ্পাপ দুই শিশুকে কারা, কেন এভাবে হত্যা করল, কেন এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল তা পুলিশসহ স্থানীয় কারও জানা নেই। কোনো মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব নয়, যারা করেছে তারা অমানুষ। কি নির্মম! কি নিষ্ঠুর সমাজ!
এসব ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পুলিশ বলছে, ঘটনাটি রহস্যজনক। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাদের জন্য শিশু দুটির বাবা-মাকে আটক করা হয়েছে। এভাবে কত শত শিশু নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, যা খুবই বেদনাদায়ক।
আমরা শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করি কি? এটাই প্রশ্ন। শিশুদের নিয়ে আর কোনো অবহেলা নয়। তাদের অধিকার সুনিশ্চিত, মানসিক বিকাশে সহায়তা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে প্রায় ১৭ হাজার শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। বর্তমানে এসব সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে থেমে থাকেনি শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন। প্রায়ই খবরের কাগজে এসব দুর্ঘটনা দেখতে পাই, যা খুবই দুঃখজনক। আরও দুর্ভাগ্য যখন শুনি বাবা নিজের কন্যাকে ধর্ষণ করে। সংবাদপত্রে দেখতে পাই নিজের ১২ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় চট্টগ্রামে এক বাবাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এরকম আরও ঘটনা রয়েছে। অর্থাৎ সমাজের চরম বিপর্যয় ঘটেছে। বাবা হয়ে নিজের সন্তানকে ধর্ষণ করা একটি গুরুতর সামাজিক অপরাধ। বাবা-কন্যার সম্পর্ক অত্যন্ত পবিত্র। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের জন্য এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত। এ ধরনের ঘটনায় সমাজে পারিবারিক সম্পর্কের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কি এক খারাপ সময় অতিবাহিত করছে দেশ ও জাতি, যা নিয়ে সরকার, অভিভাবক এবং আমরা সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এসব থেকে আমাদের খুব শীঘ্রই মুক্তি পাওয়া দরকার। অন্যথায় আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে ও যাবে। শিশুরাই ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তাদের আমাদের রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করা সরকার এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক সমস্যা। শুধু আইন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সামাজিকভাবেই এটি মোকাবিলা করতে হবে।
গত ৮ মাসে দেশে ৪৯৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। উক্ত সময়ে ১০১ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৩২২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয় ৭২ জন্য কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ৩৯ জন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে ৭০ জন মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও চলতি বছরে গত ৮ মাসে মোট ৩২৯ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই সময়কালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশু। গত মার্চ মাসে দেশে ২৪৮ জন কন্যাশিশু এবং ১৯৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২৫ জন কন্যাশিশুসহ ১৬৩ জন, যা এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। যেখানে ১৮ কন্যাশিশুসহ ৩৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। দুই কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এছাড়া ৫৫ কন্যাশিশুসহ ৭০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, যা খুবই ভয়াবহ। প্রশ্ন হলো, কেন এসব ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বারবার ঘটে? কঠোর বিচার হলে এসব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা সামাজিক অবক্ষয় এজন্য অনেকাংশে দায়ী।
সমাজে শিশু নির্যাতন বা ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা এমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুদের মনে এক আতঙ্ক এবং ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শিশুরা যেখানে যায় সেখানে তারা ভয়ভীতিতে বসবাস করে, যা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। এভাবে শিশুরা আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠলে তাদের ভেতরে সুস্থ বুদ্ধি, মননশীল চিন্তা-চেতনা বা সৃজনশীল মেধার বিকাশ হওয়া কঠিন। এছাড়াও ধর্ষণ বন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল থাকায় একে অপরের প্রতি এক ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হয়। নানা ধরনের নেতিবাচক চিন্তা শিশুদের মনে আসে। ফলে ছেলেদের মনে ধর্ষণ বা খারাপ কাজের প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে থাকে অনেক সময়। তাই মনে করি, শিশুকাল থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল না থাকাই ভালো, যাতে একে অপরকে বন্ধু এবং নিকটতম সঙ্গী ভাবতে পারে।
ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যু হয়েছে ৫৪১ জনের। তাদের মধ্যে ১৫ বছর ও এর কম বয়সী ৬১ জন শিশু রয়েছে। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তন, দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসার কারণে শিশুমৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই শিশুদের প্রতি বেশি নজর দিতে হবে, যাতে তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হয়।
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। তবে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা তিন-চতুর্থাংশের বেশি।
সামাজিক নানাবিধ সংকট শিশুদের ওপর অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যেমনÑ দারিদ্র্যের ঝুঁকি, সামাজিক অবক্ষয়। আরও অনেক কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে এবং সহিংসতা এবং অপব্যবহারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্বেগজনক চিত্র কারও খুব বেশি অজানা নয়। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩-এর তথ্যানুযায়ী ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের সময়ে বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সী মেয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ, যা খবুই বিপজ্জনক।
ফুল যেমন পাপড়ি মেলে সৌরভ ছড়ানোর অপেক্ষায় থাকে, তেমনি শিশুরাও একদিন ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবেÑ এই অপেক্ষায় থাকে দেশ। কিন্তু প্রতিদিন নির্মম কিছু দুর্ঘটনা দেখতে পাই, যা মেনে নিতে কষ্ট হয়। বিকশিত হওয়ার আগে অনেক নিষ্পাপ শিশুকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেলি, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন, পানিতে ডুবে বা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া খুবই দুঃখজনক। এসব আমাদের প্রবল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এক একটি শিশু এক একটি স্বপ্ন ও ফুল।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
প্যানেল