
ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া নারীর প্রতি হয়রানিমূলক ঘটনাগুলো বর্তমানে দেশের অতি উদ্বেগজনিত বিষয়গুলোর একটি। গণপরিবহনে নারী উত্ত্যক্তকারীদের দ্বারা হেনস্তা, ক্রেতাদের দ্বারা দরদাম ও পণ্যসামগ্রী বিষয়কে কেন্দ্র করে হেনস্তা, রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক মাধ্যমে পোশাকসহ নানা বিষয় নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য এমনকি নিজ গৃহেও নারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে- যার অন্যতম প্রধান কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারী বিদ্বেষী মনোভাব। যেমন- বহু আগে থেকেই বাসে নারীরা শারীরিকভাবে অস্বস্তিকর ও অনিরাপদ পরিবেশের শিকার হয়ে এসেছে। ফলে নারীদের জন্য ৯টি সিট বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ সিটকে পুরুষ সিট হিসেবে আখ্যায়িত করে সেখানে নারীরা বসতে পারলে নারী সিটে কেন পুরুষরা বসতে পারবে না- এমন প্রশ্নে কিছু পুরুষরা নারী সিটগুলো দখল করে রাখে। নারী-পুরুষ সাম্য অধিকার চাওয়ার মানে এই নয় যে নারী-পুরুষে আর কোনো ভিন্নতা নেই। বরং এই চাওয়া সেইসব নিয়মের বিরুদ্ধে যেখানে উভয়ই সমান পরিশ্রমী ও যোগ্য হলেও সম্মানী থেকে শুরু করে সমাজের পদমর্যাদায় পুরুষকে প্রাধান্য দিয়ে আসা আর দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও শুধু নারী হওয়ায় তাকে সক্ষম মনে করা হয় না।
গণপরিবহনে শারীরিক হয়রানির শিকার হওয়ায় নারীর নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যেই মূলত পৃথক নারী আসনের ব্যবস্থা, নারীদের আলাদা সুযোগ-সুবিধা দিতে নয়। এই শারীরিক হয়রানি বা হেনস্তার শিকার নিশ্চয় কোনো পুরুষকে হতে হয় না। আবার প্রকৃতভাবেই অধিক বল ও জোর না থাকায় গণপরিবহনে নারীদের জন্য চলাচল করা তুলনামূলক বেশি কষ্টসাধ্য। এজন্যও কিছু পৃথক আসন বরাদ্দ। শারীরিক গঠন ভিন্ন বলেই নারী-পুরুষকেও সর্বক্ষেত্রে ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই এখানে তুলনা করা এক নীচু মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আবার অনেক যাত্রী মনে করেন খালি সিট না থাকলে নারীদের যেন বাসে না ওঠানো হয়। স্বাভাবিকভাবে মেয়েরা নিজেরাও দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে অস্বস্তিকর বোধ করে। তবে যখন নির্দিষ্ট সময়ে অফিস, পরীক্ষা-ক্লাসসহ নানা কারণে যাতায়াত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে তখন ভিড় থাকা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এতে কিছু পুরুষ যাত্রীর তীব্র প্রতিক্রিয়াসহ বাসে মহিলা না ওঠানো নিয়ে মন্তব্যগুলো নারীদের জন্য খুবই অপমানজনক ও অবমাননাকর, যা সামগ্রিক ভাবনার উদ্দেশ্যকেই আড়াল করে দেয়। জীবিকা নির্বাহসহ পুরো পরিবারের আর্থিকভাবে দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্মজীবী নারীদের পক্ষে সবসময় পৃথক যানবাহন ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কেননা তা অধিক ব্যয়বহুল। ফলে তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু পরিবহনগুলোতে পুরুষদের দ্বারা আকার ইঙ্গিত ও বিদ্রুপ মন্তব্যে নারীরা যেভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়ে থাকে, তা তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
আবার দরদাম ও একাধিক পণ্য দেখতে চাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় নারী গ্রাহকের ওপর ক্রেতাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে এক নারীর অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কারণে রেস্তোরাঁর এক কর্মচারী দ্বারা তাকে পিটানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানে মেয়েটি যদি রেস্তোরাঁয় কোনো অসামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করেও থাকে তবে তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতো। তবে তার ওপর হওয়া শারীরিক নির্যাতন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের বিশেষ করে তাদের জনপ্রিয় মুখদের প্রচুর বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয়, যার মধ্যে ধর্ষণ ও মৃত্যু হুমকি পর্যন্ত রয়েছে। এছাড়াও নারী নির্যাতন বিষয়ে যারা সহমত পোষণ করে অনলাইনে নারী বিদ্বেষী মনোভাব ছড়িয়ে দেয়, তাদের প্রতিও সোচ্চার ব্যবস্থা নিতে হবে কেননা, তাদের মানসিকতাও সমাজে নারী অবমাননার জন্য অনেক আংশে দায়ী। সামাজিক মাধ্যমে নারীনিরাপত্তা নিয়ে জোর পদক্ষেপ না নিলে এরকম কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই তাদের জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও স্বামীর দ্বারা শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন। গত ১২ মাসে ৪১ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অডিটোরিয়ামে ‘নারীদের ওপর সহিংসতা শীর্ষক জরিপ ২০২৪’-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। এতে আরও বলা হয়, সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেন। বাকি ৯৩ দশদিক ৬ শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এছাড়া সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কখনো কাউকে বলেনওনি। জরিপে দেখা যায় যে, নারীদের অন্য কারও তুলনায় স্বামীদের কাছ থেকে শারীরিক সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা তিনগুণ বেশি এবং যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ১৪ গুণ বেশি। এতে প্রতীয়মান যে, নিজ বাসায়ও নারীর নির্যাতনের ঘটনা কতটা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছ।
তবে আজকাল বাংলাদেশ পুলিশের নারী নির্যাতন মূলক কিছু ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে, যা সাময়িক স্বস্তির হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যথেষ্ট নয়। নারী নির্যাতন আইনের কঠোর ও বাস্তবিক প্রয়োগ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই এরকম হয়রানি দমাতে পারবে। তবুও সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। রাস্তাঘাটে কারোর পোশাক আপনার নিকট দৃষ্টিকটু মনে হলেই তাকে হেনস্তা করা বা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করা যাবে, এমন ভাবনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আবার কোনো বিষয় কেন্দ্রিক দ্বিমতের ফলে শুধু নারী হওয়ায় তার প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়াসহ ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন ও অবমাননা করার সাহস দেখানো যেন আরেক কাপুরুষতার পরিচয়। এরকম পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি সকলের সোচ্চার প্রতিবাদই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া নারীর প্রতি সহিংসতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল