ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

আধুনিক জীবনের অদৃশ্য যন্ত্রণা

মোসা. মিশকাতুল ইসলাম মুমু

প্রকাশিত: ২০:০৫, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

আধুনিক জীবনের অদৃশ্য যন্ত্রণা

মানবজীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখার জন্য ঘুম অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিনের ক্লান্তি দূর করে শরীর ও মনকে চাঙ্গা করতে ঘুমের বিকল্প নেই। কিন্তু যখন সেই ঘুম ব্যাহত হয়, তখনই জন্ম নেয় এক অদৃশ্য যন্ত্রণা- যার নাম অনিদ্রা। অনিদ্রা শুধুই ঘুমের অভাব নয়; এটি এক ধরনের মানসিক ও শারীরিক অস্থিরতা, যা ধীরে ধীরে ব্যক্তির স্বাস্থ্য, মনোভাব এবং দৈনন্দিন জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। কাজের চাপ, মানসিক উদ্বেগ, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারসহ নানা কারণেই এই সমস্যা বাড়ছে। আধুনিক জীবনের দ্রুতগামী ছন্দে অনিদ্রা যেন এক নীরব সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাতে ঘুম না আসা বা এলেও বারবার ভেঙে যাওয়াকে বলা হয় ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগ। এটি প্রধানত তিন ধরনের হয়ে থাকে। অল্পকালীন অনিদ্রা, যা সাধারণত কিছুদিনের জন্য ঘটে এবং কোনো বিশেষ ঘটনা বা স্ট্রেসের কারণে যেমন- কাজের চাপ বা পারিবারিক সমস্যা থেকে হতে পারে। দীর্ঘকালীন অনিদ্রা, যা ৩ মাস বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয় এবং এটি সাধারণত মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা ডিপ্রেশন থেকে উদ্ভূত হয়। প্রাথমিক অনিদ্রা, যা কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যা ছাড়াই ঘটে এবং এটি সাধারণত পরিবেশগত বা জীবনযাত্রার কারণে হতে পারে। তবে সব ধরনের অনিদ্রাই শরীরের অনেক ক্ষতি করে। পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষই এখন ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা সমস্যায় ভুগছেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই ইনসমনিয়া হতে পারে। তবে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের হার কমে যাওয়া বা ঘুম পাতলা হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির কারণে ইনসমনিয়ার ভুক্তভোগী। এই সমস্যা এখন এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, অনিদ্রাকে দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে কেউ কেউ।
বর্তমান সময়ে অনিদ্রা বা নিদ্রাহীনতার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হচ্ছে অন্যতম প্রধান কারণ। আধুনিক জীবনে ব্যক্তি, পারিবারিক, আর্থিক ও পেশাগত নানা উদ্বেগ আমাদের মস্তিষ্ককে অধিক সক্রিয় রাখে। যার ফলে ঘুম আসতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। রাতে মোবাইল, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ ব্যবহারের ফলে ব্লু লাইটের প্রভাবে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। যা ঘুমের প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। তৃতীয়ত, অনিয়মিত জীবনযাপন, যেমন- অনিয়মিত ঘুমের সময় বা অতিরিক্ত ঘুমানো, ঘুমের সাইকেলকে নষ্ট করে এবং ঘুমের গভীরতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া, ক্যাফেইন বা মাদকদ্রব্য যেমন- কফি, চা বা নিকোটিন গ্রহণও ঘুমের মধ্যে সমস্যা তৈরি করে। কারণ এসব দ্রব্য স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে, যা ঘুমের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে না। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- ডিপ্রেশন, এংজাইটি ডিজঅর্ডার বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারও ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শারীরিক অসুস্থতা যেমন- ব্যথা, হাঁপানি বা হার্টের সমস্যা থাকার কারণে অনেকেই গভীর ঘুমে প্রবেশ করতে পারে না। আর একে যোগ করা যায় কাজের চাপ ও ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্সের অভাব। বিশেষ করে যারা ফ্রিল্যান্স বা রিমোট জব করেন তারা ঘুমের সময়েও কাজের চিন্তা করতে থাকেন। যার ফলে বিশ্রামের অভাব হয়। এসব নানা কারণে অনিদ্রা একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনিদ্রার প্রভাব শরীর ও মনের ওপর ব্যাপক হতে পারে। এটি মানসিক স্বাস্থ্যে উদ্বেগ, ডিপ্রেশন এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি করতে পারে। শারীরিকভাবে, দীর্ঘ সময় অনিদ্রা থাকার ফলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার মতো সমস্যা হতে পারে। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা যেমন- স্মৃতি, মনোযোগ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সহজে সংক্রমণ হতে পারে। কর্মস্থলে কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অনিদ্রার কারণে দৈনন্দিন কাজগুলো করতে ক্লান্তি এবং অবসাদ অনুভূত হয়, আর সামাজিক সম্পর্কেও খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। সুতরাং, অনিদ্রা একটি গুরুতর সমস্যা, যা শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এক গবেষণা বলছে, কেউ টানা ১৭ থেকে ১৯ ঘণ্টা জেগে থাকলে মস্তিষ্কে যে ধরনের প্রভাব পড়ে, অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেও একই ধরনের প্রভাব পড়ে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। গবেষণায় বলছে, কোনো ব্যক্তি যদি টানা ১১ দিন না ঘুমিয়ে থাকে, এতে স্বাভাবিক আচরণ ও দৈনন্দিন কাজেকর্মে মারাত্মক প্রভাব পড়ে, যা তাকে শর্ট টাইম মেমোরি লস থেকে শুরু করে হেলুসিনেশন, এমনকি মস্তিষ্ক বিকৃতির দিকেও নিয়ে যেতে পারে। অনেকেই আছেন একটু ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলেই শুরু করে ঘুমের ওষুধ সেবন। এটা একেবারেই উচিত নয়। এতে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। একসময় এমন অবস্থা দেখা দেয়, ওষুধ সেবন ছাড়া ঘুম আসে না। ওষুধের ডোজও বাড়াতে হয়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এসব ওষুধ সেবন করা উচিত।
অনিদ্রা প্রতিরোধে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ রয়েছে। প্রথমত, নিয়মিত ঘুমের অভ্যাস গঠন করা জরুরি। প্রতিদিন একই সময়ে শোয়া এবং ওঠা শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি ঠিক রাখে। শারীরিক ব্যায়াম নিয়মিত করা উচিত। তবে ঘুমানোর আগে ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলা উচিত। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং রাতের খাবারে ক্যাফেইন, অ্যালকোহল বা ভারী খাবার এড়িয়ে চলা অনিদ্রা প্রতিরোধে সাহায্য করে। ঘুম না এলে বিছানায় শুধু শুয়ে না থেকে বিছানা থেকে উঠে কম মনোযোগ দিতে হয় এমন কাজ যেমন- বই, পত্রিকা পড়া, মৃদু বাজনার গান শোনা যেতে পারে। তাছাড়া ঘুমের পরিবেশে শান্তি বজায় রাখতে ঘরটি শীতল, অন্ধকার এবং নীরব রাখা উচিত। প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা রাখুন। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার বন্ধ করুন। মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধ্যান বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ব্যবহার করুন। ঘুমানোর আগে গরম পানির স্নান করলে শারীরিক শিথিলতা আসে। এই সব অভ্যাস অনিদ্রা থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক হতে পারে। তবে যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনিদ্রা শুধু শারীরিক সমস্যা নয়, এটি মানসিক স্বাস্থ্যেও গভীর প্রভাব ফেলে। ঘুমের অভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবন, মনোভাব এবং কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। আজকের প্রযুক্তি ও মানসিক চাপের যুগে অনিদ্রায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের রাতের নিস্তব্ধতা নিদ্রাহীন দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ। তাই ঘুমকে গুরুত্ব দেওয়া, সুস্থ জীবনযাপনের অংশ হিসেবে প্রতিদিনের রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শুধু ভালো ঘুমের মাধ্যমে আমরা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারি। একে যদি আমরা স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করি, তবে জীবনের অন্যান্য দিকেও সুখ, শান্তি এবং পরিপূর্ণতা আসবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

×