ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

নিত্য পণ্যের বাজার দর

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:০৩, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

নিত্য পণ্যের বাজার দর

২০২৪ এর জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানে বিদায় নেয় ১৬ বছরের এক দীর্ঘ মেয়াদি দুঃশাসন। যে কোনো রাষ্ট্র কিংবা শাসন ক্ষমতা কোনো এক ব্যক্তির হাতে যখন কেন্দ্রীভূত হয় সেখানে কাঠামোর অভ্যন্তরে হরেক জঞ্জাল, দুঃশাসন আর অপকর্মের বীজ বুনতে সময়ও লাগে না। তাই কোনো সংস্কার আন্দোলন থেকে নবপ্রজন্মের নতুন বাংলাদেশ উপহার দেওয়া জাতির জন্য কাক্সিক্ষতই শুধু নয় অপরিহার্যও জরুরি ছিল। সংসদীয় নির্বাচনের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আধুনিক গণতন্ত্রের অভাবনীয় এক জাগরণ। দীর্ঘ শাসন স্বৈরতন্ত্র আর একনায়কের অভ্রভেদি চূড়ায় দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হওয়া ইতিহাসের নিয়মানুগ ধারা। সঙ্গত কারণে ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়া ভেলি দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেনÑ সকল ক্ষমতাই মানুষকে বিকৃত করে চরম ক্ষমতা মানুষকে চরমভাবে বিকৃত করে। আমরা একাবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যাহ্নেও অন্য কিছু ভাবতে হিমশিম খাচ্ছি। স্বৈরশাসন, একাধিপত্য আর নির্বাচনের নামে যে প্রহসন জাতি দেড় দশক ধরে দেখেছে তাও এক কঠোর প্রতিবন্ধকতা। সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুভ যাত্রায় কাঠামোর অভ্যন্তরে শিকড়ে গজানোর যে দুর্বিষহ দাবানল তা সম্মুখ সমরে এগিয়ে যাওয়াও ছিল উদ্ভূত পরিস্থিতির ন্যায্যতা। লাগাতার অপশাসনের চরম একাধিপত্যে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় এক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি। সবার আগে মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হয়। সেটা যেমন ব্যক্তি মানুষের ন্যায্য পাওনা, অপরদিকে বিপরীত দাবানলও সিংহভাগ মানুষের নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। দ্রব্যমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন সিন্ডিকেটের দাপট ছিল যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে একই শিকলে আটকানো। নিত্য খাদ্যপণ্য সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়াও যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিন্নমাত্রার দুরবস্থা। চিহ্নিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কখনো ধরা পড়েনি। সামান্যতম আঁচও লাগেনি তাদের দৌর্দণ্ডপ্রতাপ নিত্য বাজারের ওপর প্রভাব প্রতিপত্তিতে। পেঁয়াজ কাণ্ড ছিল তারই এক অভ্যন্তরীণ বাজার সিন্ডিকেটের উন্মত্ত আস্ফালন। সিন্ডিকেটের এমন দৌরাত্ম্যের পরবর্তীতে বস্তা পচা পেঁয়াজ নদী ও সমুদ্রের পানিতে বিলীন হতেও দেখা গেছে। তেমন দুঃশাসন আর দুরন্তপনা কাটতে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা জাতির জন্য ছিল এক অসময়, ক্রান্তিকাল। সেখান থেকে শিক্ষার্থী আন্দোলনের শুভ সূচনায় নব জাগরণের যে ধারা তাতে নতুন অন্যরকম বাংলাদেশের অভ্যুদয় জাতিকে যে স্মরণের আবরণে এগিয়ে দিল সেখান থেকে ভিন্ন মাত্রার রাষ্ট্র গঠন সময়ের ন্যায্যতা বলাই যায়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পরই যে অন্তর্বর্তী সরকার তাও নতুন সময়ের অন্য মাত্রার রাষ্ট্রীয় কাঠামো। তেমন ব্যবস্থাপনায় দেশের সাধারণ মানুষ কতখানি নিরাপদ আর খাদ্যপণ্যে স্বস্তিতে আছে তাও এক দৃশ্যমান বাস্তবতা। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন আপেক্ষিক একইভাবে সময় আরও উদ্ভূত ঘটনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। নতুন বাংলাদেশ তার সার্বিক চলার পথে অনেকটাই স্বচ্ছন্দ আর নির্বিঘ্ন। মূল কারণ স্বস্তিতে খাওয়া-পরায় কোনো বিঘ্ন বিপত্তি না ঘটাও বর্তমান পরিস্থিতির সহনীয় পরিবেশ। বিশেষ করে এবার আলু থেকে পেঁয়াজ, শসা, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া যা সাধারণ মানুষের নিত্য  ভোগ্যপণ্য সেখানে সেভাবে দাম চড়াও হয়নি বলে তথ্যে দৃশ্যমান হয়। তবে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ স্থিরভাবে মূল্যে এক জায়গায় থাকেনি। সম্প্রতি তেল নিয়ে শুরু হয়েছে তেলেসমাতি। বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়া আর এক ভিন্নমাত্রার প্রকোপ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যটির। বিষয়টা শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী শ্রেণি এমন বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে বলে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় উঠে আসছে। সেই ১৭৬০ সালের শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই।
বাংলাদেশ এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে পরিচালিত হচ্ছে। সামনে অপেক্ষা করছে এক গ্রহণযোগ্য আর অংশগ্রহণমূলক স্বস্তিদায়ক ভোটাধিকার প্রদানের সার্বিক স্বাধীনতা, অধিকার, তা যেন পুরানো কোনো অপসংস্কারের জালে আটকা না পড়ে। নিত্য বাজার ব্যবসায়ী শ্রেণি আর গ্রাহকের মাঝখানে আর এক ধূম্রজাল বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। সেখানে খোদ কৃষকই থাকে সর্বাগ্রে। শস্যক্ষেত্রে বীজ রোপণ করা থেকে কৃষকের ঘরে ফসল ওঠার পর্যায় পর্যন্ত। পরবর্তীতে তা শুধু বাজারজাত নয় বরং সিন্ডিকেটের যে একাধিপত্যে পড়ে সেখানে খোদ উৎপাদক আর ভোক্তা শ্রেণির মাঝখানে যে প্রাচীর ভোগ্যপণ্যকে লাগামহীন করে দেয় তা অদৃশ্য কোনো কিছু নয়। চেনা, জানা, শোনা এক শ্রেণির লাগামহীন মুনাফাভোগী বিরাট চক্র। যাদের কখনো দেখা যায় না সেভাবে ধরাও পড়ে না। মাঝখান থেকে নিপীড়িত হয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কৃষক।  পরবর্তীতে অতি সাধারণ ভোক্তা শ্রেণি। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় মাঝে মধ্যে কাঁচা মরিচের তীক্ষè ঝাঁজ এসে লাগে মানুষের নিত্য জীবন প্রবাহে সেখানে শুকনা মরিচও অবিচ্ছিন্ন থাকেই না। বাংলাদেশে এখনো সিংহভাগ অঞ্চলই গ্রামবাংলার সুশোভিত ধনে ধান্য পুষ্পে ভরা এক মনোহর নৈসর্গিক বরেন্দ্র ভূমি। নদ-নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত আবহমান বাংলা মাছে ভাতে বাঙালির প্রচলিত প্রবাদের সুরম্য উর্বর ভূমি। তেমন শস্য শ্যামল পুষ্পিত বঙ্গভূমি যুগ-যুগান্তরের পরম নির্মাল্য। কবি গুরুর ভাষায়Ñ এই বাংলার মাটিতে নাকি বীজ মাত্রই সোনা ফলে। যথার্থ সত্য কখন। তবে সময়ের প্রবহমান গতিও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রসারণে ভূমির উর্বরা শক্তি কমে যাওয়াও চিরস্থায়ী এক প্রকোপ। তার ওপর সীমাবদ্ধ জমি আয়তনেও বাড়ে না। বরং হরেক অবকাঠামোর অত্যাধুনিক রূপায়ণে জমির জায়গা কমে যাওয়া ছাড়াও ফসলি খেতের ওপর নানামাত্রিক উৎপাতও কৃষিজাত পণ্যের বহুমাত্রিক দাবানল। তার ওপর দখলদার গোষ্ঠীর প্রাবল্য থাকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জবর দখলের প্রকোপ থেকেও সুরক্ষিত থাকে না। যেখানে আছে একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন আর একক পরিবারের সংহত রূপকল্প। সেখানেও সীমাবদ্ধ ফসলি জমির দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাওয়া শস্য শ্যামল সবুজ প্রান্তরের এক অবধারিত খণ্ড-বিখণ্ডে চলে যাওয়া। তবে অতি আবশ্যক শিল্প প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও যথাযথ ব্যবহারে আধুনিক বিশ্ব নতুন মাত্রার রূপ নিয়ে সময়কে মান্যতা দেওয়া। ফলে সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার প্রদাহকেও সহ্য করা ছাড়া বিকল্প পথও অজানা। তবে শ্যামল বাংলার ফসলি মাঠের আজও যে মাত্রায় শস্য সম্ভারের প্রাচুর্য সেখানে জনসংখ্যা বাড়লেও খাদ্য ঘাটতির সুযোগ সেভাবে থাকে না। তার পরও কিছু মানুষের অসদুপায় অবলম্বনে সাধারণ জনের যে ভোগান্তিক অশান্তি, খাদ্যপণ্যের ওপর অহেতুক অযাচিত ছাপ সত্যিই কোনোভাবেই মানা যায় না। এবার রমজান মাসেও তেল-পেঁয়াজের দাম সেভাবে লাগাম ছাড়া হয়নি। কিন্তু পরের সময়গুলোতে পেঁয়াজ কিছুটা চড়াও হলে তেল নিয়ে কারসাজি কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সয়াবিন তেলের কেজিপ্রতি মূল্য বাড়াই নয়, সময় অসময় লাপাত্তা হয়ে যাওয়া পরিস্থিতির চরম দুর্বিপাক। সাধারণ মানুষ যদি খেয়ে-পরে শান্তিতে বিশ্রাম-ঘুম নিতে না পারে তা হলে দৈনন্দিন জীবন স্বস্তি আর শান্তিময় থাকে না। যে কোনো খাদ্যপণ্যে খোদ উৎপাদক, ভোক্তা আর মালিক শ্রেণির যে তিন ধাপ পার হওয়া সেখানে সবচেয়ে অসহায় থাকে গ্রাহক, মাঝখানে কৃষককেও ভুগতে হয় নানা দুর্বিপাকে। তবে সিন্ডিকেটের কারণে ব্যবসায়ী কিংবা মালিক পক্ষ সেভাবে লোকসানের আওতায় পড়েই না। লভ্যাংশে কিছুটা ওঠা-নামা করলেও ক্ষতির সম্মুখীন কোনোভাবেই পড়তে হয় না। নতুন ও বদলে যাওয়া বাংলাদেশ নানামাত্রিক দুর্ভোগ মোকাবিলা করেও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে সম্ভাবনার বহুমাত্রিক পথে। নৈসর্গের অপার মহিমায় বাংলাদেশ যে মাত্রায় সামনে এগিয়ে যায় সেটা যেমন দৃষ্টিনন্দন। আবার বিপরীত প্রদাহ ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, শৈত্যপ্রবাহ এমনসব প্রাকৃতিক বৈপরীত্যকেও মোকাবিলা করেই চলার পথকে নির্বিঘ্ন নিষ্কণ্টক রাখা আবহমান বাংলার চিরায়ত বৈভব। সঙ্গেও রুদ্র প্রকৃতির বিপরীতে লড়াই, সংগ্রামও যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার আগামীর যাত্রাপথে সিংহভাগ মানুষের প্রতি পরম দায়বদ্ধতাও এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। প্রকৃতির উন্মত্ত আস্ফালনে নয়-ছয়কে সামলানো কঠিন। তবে মানুষের নিজের তৈরি করা অপকর্ম এবং অপশক্তিকে ঠেকানো কঠিন কিছু নয়। সংস্কার আর অপসংস্কারের যাত্রা পথে কোনো অশুভ শক্তির পদচারণা সমূলে নস্যাৎ করে দিতে অধিবাসীদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। সেখানে আধুনিক ও উদীয়মান প্রজন্ম কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে যেভাবে স্বৈরশাসনের অপঘাতের মধ্যে মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। তেমন দুর্দমনীয় শুভশক্তির পরম বরমাল্যে কাঠামোর অন্তর্জালে জিইয়ে থাকা হরেক প্রদাহকেও স্তিমিত অবস্থায় নিয়ে আসা নতুন বাংলাদেশকে আরও নিয়মতান্ত্রিক, গঠনতান্ত্রিক এবং শুভশক্তির অনবচ্ছেদ মিলন গ্রন্থিতে সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আধুনিক নব প্রজন্মের পক্ষেই সম্ভব।

×