
গাজার যুদ্ধের পর ১৩ মাস ধরে লেবানন-ইসরাইল সীমান্তে পাল্টাপাল্টি হামলা চলে আসছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিয়েছিল ইসরাইল। লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনপন্থি কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। ইসরাইলি বিমানবাহিনী দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। সীমান্ত থেকে ছোড়া রকেট হামলার জবাবে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু লেবাননে ডজনের বেশি লক্ষ্যবস্তুতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী টঘওঋওখ জানিয়েছে, এই আকস্মিক সংঘর্ষ নতুন করে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে; যা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্জিত শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। তারা উভয় পক্ষকে সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, অতিমাত্রায় উত্তেজনা পুরো অঞ্চলে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই উত্তেজনা এমন এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে, যে সময় ইসরাইল গাজায় নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু করেছে। এ বছরের জানুয়ারির পর প্রথমবারের মতো এত বড় মাত্রায় হামলা চালানো হলো, যা সাম্প্রতিক সময়ের শান্তি প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ইসরাইল এখনো লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সৈন্য মোতায়েন রেখেছে। যদিও গত বছরের নভেম্বর মাসে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইসরাইল। লেবাননের প্রেসিডেন্ট দপ্তর ওই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, দেশকে আবারও সহিংসতার চক্রে টেনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন সেনাবাহিনীকে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং হামলার তদন্ত চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ লেবানন সরকারকে দায়ী করে বলেছেন, উত্তর ইসরাইলের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা তা করব। ২৮ মার্চ প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি জানান, লেবানন থেকে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এ নিরাপত্তা হুমকির জন্য কঠোর জবাব দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। তিনি আরও জানান, লেবানন থেকে উৎক্ষেপণ করা ক্ষেপণাস্ত্রটি তারা বাধা দিয়েছেন এবং এর বিরুদ্ধে নিরাপত্তার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিক্রিয়া জানান। এছাড়া গ্যালিলের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ^াসও তিনি প্রদান করেন। তবে এখন পর্যন্ত লেবানন সরকার বা হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুই পক্ষের এমন আচরণে জারি থাকা যুদ্ধবিরতি চুক্তি যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগেও লেবাননে ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়েছিল। ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয়, ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো লেবাননের পূর্ব বালবেক অঞ্চলের জান্তা শহরের উপকণ্ঠে হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষকদের নিকট হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে তারা হামলা চালিয়েছে। হামলার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে আছে রকেট ছোড়ার একটি স্থান, একটি সামরিক ক্ষেত্র ও সিরিয়া-লেবানন সীমান্ত বরাবর চোরাচালানের পথ। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র পাচারের জন্য এই পথ ব্যবহার করা হয়। টঘওঋওখ জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি অনেক নাজুক হয়ে পড়েছে। তারা হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলকে তাদের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখার জন্য উৎসাহিত করছে। ইসরাইলের প্রধনমন্ত্রী বলেছেন, হুমকি প্রতিরোধ ও যুদ্ধবিরতির শর্ত বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনে লেবাননের যে কোনো স্থানে হামলা করতে তারা প্রস্তুত রয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, লেবাননের পরিস্থিতি থেকেও এতদিন যারা শিক্ষা নিতে পারেনি, এ হামলার কারণে তারা আমাদের অঙ্গীকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে। আমাদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে আঘাত, সেটা যত সামান্যই হোক, আমরা মেনে নেব না। গত বছর বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলিতে প্রায় প্রতিদিনই ইসরাইলি বিমানবাহিনী হামলা চালিয়েছিল। তাদের হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্ব প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সংগঠনটির শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহও নিহত হন।
এখানে উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবানন থেকে তাদের অস্ত্র সরাতে, ইসরাইল স্থল বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে এবং লেবাননের সেনাবাহিনীকে এলাকায় মোতায়েন করতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। যুদ্ধবিরতির ফলে লেবাননে স্থল অভিযানের পাশাপাশি ইসরাইলের বোমাবর্ষণ এবং ইসরাইলে হিজবুল্লাহর বোমাবর্ষণ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে শর্তগুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নে ব্যর্থতার অভিযোগ করে আসছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে, তারা এ ধরনের হামলা চালিয়ে যাবে যাতে হিজবুল্লাহ পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এখনো দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি স্থান দখল করে আছে। লেবানন সরকার বলছে, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং একইসঙ্গে চুক্তিরও লঙ্ঘন। ইসরাইল বলছে, লেবাননের সেনাবাহিনী এখনো পুরোপুরি ওই এলাকাগুলোতে মোতায়েন হয়নি এবং সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তারা সেখানে অবস্থান করছে বাধ্য হয়েই। ইসরাইলের ওই হামলা লেবানন সেনাবাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ তারা দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে, যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে হিজবুল্লাহর শক্তিশালী উপস্থিতি ও সমর্থন রয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে সংঘর্ষে হিজবুল্লাহ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাদের অনেক নেতা ও যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারের বড় একটি অংশও ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই অভিযানে লেবাননে প্রায় চার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। ১২ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরাইল বলছে, তাদের লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর হামলার কারণে নিজেদের উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রায় ষাট হাজার বাসিন্দার ফেরার পথ সুগম করা এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে হিজবুল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া। তবে লেবাননকে এ সংঘাতের মধ্যে টেনে নেওয়ার প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াফ সালাম জানিয়েছেন, এ উত্তেজনা লেবাননের জন্য নতুন করে যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করছে।
গত ২৬ মার্চ হিজবুল্লাহর মহাসচিব শেখ নাইম কাসেম জানিায়েছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে কোনো প্রক্রিয়া লেবানন মেনে নেবে না। দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের চলমান আগ্রাসনের তিনি নিন্দা জানান। হিজবুল্লাহ এবং লেবাননের দৃঢ় প্রতিরোধ চলছে; যা ইসরাইলকে তার লক্ষ্য অর্জন করতে দেয়নি। লেবাননের সার্বভৌমত্ব এবং দেশটি থেকে ইসরাইলি বাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রতি হিজুল্লাহর প্রতিশ্রুতির কথা তিনি উল্লেখ করেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন এবং লেবাননের অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে চাপ দিতে তিনি আহ্বান জানান। ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে এবং এবং ইসরাইলি আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে মার্কিন-ইসরাইলি কৌশল বলে তিনি মনে করেন। হিজবুল্লাহ এবং তার আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ ফ্রন্ট ওই ধরনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন। লেবাননে ইসরাইলের বিধ্বংসী হামলার নিন্দা জানিয়ে হিজবুল্লাহর প্রতি ইয়েমেনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে হুতি নেতা আব্দুল মারিক বদরুদ্দিন আল-হুতি জানিয়েছেন, লেবাননের বিরুদ্ধে ইসরাইলি আগ্রাসন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিলে হিজবুল্লাহর পাশে থেকে ইয়েমেন লড়াই করবে। ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলাকে বর্বর ও অন্যায্য আখ্যা দিয়ে হুতি নেতা বলেন, এই নিষ্ঠুর ও অন্যায্য আগ্রাসনের কোনো যুক্তি নেই। হিজবুল্লাহ ও লেবাননের জনগণের প্রতি সানা সরকারের দৃঢ় ও নীতিগত সমর্থনের বিষয়েও তিনি জানান।
ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত লেবানন একটি পর্বতময় দেশ। এটি এশিয়া মহাদেশের পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। এর দক্ষিণে ইসরাইল, উত্তর ও পূর্বে সিরিয়া এবং পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর ও সাইপ্রাস। ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকা এবং আরব পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগস্থলে এর অবস্থান সমৃদ্ধ ইতিহাসে অবদান রেখেছে এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যের একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরি করেছে। প্রথম বিশ^যুদ্ধের পূর্বে লেবানন নামের কোনো রাষ্ট্র ছিল না। প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর ফ্রান্স লেবানন ও সিরিয়া অঞ্চল শাসনের অধিকার প্রাপ্ত হয়। সেই সূত্র ধরে ১৯২০ সালে ফ্রান্স লেবানন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯২৬ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৪৩ সালে দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ ছিল প্যান আরব জাতীয়তাবাদ এবং প্যালেস্টাইন সমস্যা। এই দুই কারণে লেবানন মাঝে মধ্যেই বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ অথবা সামরিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। আর হিজবুল্লাহ হচ্ছে একটি আরবি ভাষার শব্দ, যার অর্থ আল্লাহর দল। এটি শিয়া ইসলামি রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন। লেবাননের গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯৮২ সালে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো। নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দীর্ঘ যুদ্ধের পর ২০০০ সালে হিজবুল্লাহ তাদের লক্ষ্য অর্জন করে, যখন তারা ইসরাইলকে সরে যেতে বাধ্য করে। মূলত ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য লেবাননে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গোষ্ঠীটি লেবাননের শিয়া জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন অর্জন করে এবং এটি সামরিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। হিজবুল্লাহ ইরান সমর্থিত গোষ্ঠী এবং সরকারের অংশ; যারা ‘অ্যাক্সিস অব রেসিসট্যান্স’ বা প্রতিরোধ চক্র হিসেবে পরিচিত। সংগঠনটি ছিল প্রথম গ্রুপ যাদের ইরান সমর্থন করে। এটি শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়, তারা একটি রাজনৈতিক দলও বটে। লেবাননের সংসদে তাদের আইনপ্রণেতা আছে এবং কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন সরকারে তাদের প্রতিনিধি ছিল। আরব বিশে^র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আধা-সামরিক বাহিনী হচ্ছে হিজবুল্লাহ; যাদের একটি শক্ত সাংগঠনিক অবকাঠামো এবং বড় মাপের অস্ত্রাগার রয়েছে। এক লাখ যোদ্ধা আছে বলে তারা দাবি করে। লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সংগঠনটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তাদের সামরিক সক্ষতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে তারা ভূমিকা পালন করেছিল। তারা সিরিয়া এবং ইরাকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
অনেক সমস্যা লেবাননকে বছরের পর বছর ধরে জর্জরিত করে রেখেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৯ সালের অর্থনৈতিক ধস, ২০২০ সালে বৈরুতে বন্দরে বিস্ফোরণ, ২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অচলাবস্থা। ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধের অভিঘাতও লেবাননের ওপর পড়ে। কারণ লেবাননের হিজবুল্লাহ সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। ইসরাইল সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করলে শুধু হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি নয়, সমগ্র দেশেই তারা আক্রমণ করে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে ইসরাইল পেজারের নেটওয়ার্কে হামলা করে। ওই হামলা যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এরপর ইসরাইল লেবাননে বোমা হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালায়। যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে লেবানন সরকারকে চাপে রাখতে ইসরাইল এ হামলা চালাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে যত দিন লেবাননে ইসরাইলি দখলদারি চলবে, তত দিন হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। আর এবার ইসরাইলের হামলা আগের মতো তীব্র না হলেও, তারা সবসময় বৈরুত সরকারকে চাপের মধ্যে রাখতে চাচ্ছে। এদিকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা শুরু করেছে। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজায় আবার হামলা চালানোয় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র নিন্দা জানিয়েছে। গাজা যুদ্ধ হিজবুল্লাহর জন্য হুমকি হিসেবে আসে। কারণ তারা জানত ইসরাইল যদি গাজা যুদ্ধে সফল হয়, তাহলে তারাই পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু। হিজবুল্লাহকে এখন দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হচ্ছে। একদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে হচ্ছে। অন্যদিকে লেবাননের ভেতরে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ব্যবস্থার পরিবর্তন করা। অর্থাৎ প্রতিরোধের অক্ষের ভিত্তিমূল হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে ফেলা। কারণ হিজবুল্লাহ ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়ায় ইসারাইলবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। তবে হিজবুল্লাহ মনে করে, এই যুদ্ধ প্রতিরোধের ভাগ্য এবং লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। হিজবুল্লাহ তার শত্রু ও সমর্থক-উভয় পক্ষকেই দেখাতে চায় যে, সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরও তাদের শক্তি দৃঢ় এবং তারা লড়াইয়ের জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ। ইসরাইলও বহু বছর ধরেই এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। লেবাননের ভেতরের রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের কারণে হিজবুল্লাহর কাজ অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিক থেকেও হিজবুল্লাহ ক্রমাগত সমালোচনার মুখে পড়ছে। বিশেষ করে লেবাননের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধের জন্য হিজবুল্লাহকেই দায়ী করে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখনো বড় কোনো ফাটল তৈরি হয়নি। হিজবুল্লাহ এখনো পর্যন্ত ইসরাইলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু। তবে যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উত্তেজনা ততই বৃদ্ধি পাবে; যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়