
বাঙালির আত্মপরিচয় ফুটে উঠে সর্বজনীন বৈশাখের নানা উৎসবে। যুগ যুগ ধরে তারা তাদের নিজস্ব আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশ এই বৈশাখ মাসেই ঘটিয়ে থাকে। কি শহর কি গ্রাম সবখানেই যেন রুচিমাফিক আনন্দ। উৎসব আয়োজন করতে সবাইকে তৎপর এবং পরম আগ্রহে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। রমনার বটমূলে ছায়ানটের মনোমুগ্ধকর বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজনের শিল্পিত পরিবেশনার যে সূচনা হয় তার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে নিকটবর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রবীন্দ্র সরোবরসহ শহরের অন্যান্য প্রান্তে। প্রাণের গান ‘এসে হে বৈশাখ’ এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছুটে যেতে চায় নিকটবর্তী কোনো উৎসব আয়োজন কিংবা মেলায় যেখানে সে তার মনের মাধুরী মেশানো সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটতে দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা উপভোগ করে। আসলে এত সর্বজনীনতা আর কোনো উৎসবে বৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় না শুধু বৈশাখ ছাড়া।
পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতিদের বৈসাবি উৎসব থেকে শুরু করে সমতলের যত জেলা-উপজেলা আছে, সবখানেই বৈশাখীমেলা, নাগরদোলা নৌকা দোলা, রিং খেলা, যাত্রাপালাসহ থাকে বিচিত্র আয়োজনের বন্দোবস্ত। ছোট ছেলে-মেয়েরা অভিভাবকের হাত ধরে বৈশাখীমেলায় নানা প্রকার বাঁশি, খেলানা মাটির, তৈষজপত্র, বাঁশের কারুকাজ সমৃদ্ধ একতারা, দোতারা ইত্যাদির তালে তাল মিটিয়ে মিষ্টিমুখ করে তবেই না ঘরে ফেরে। তাদের অভিভাবকের কাছে এটা-ওটা কেনার আবদারও এক প্রকাশ সংস্কৃতি, যা তাদের মানসপটে গেয়ে থাকে আজীবন।
কেউ কেউ বৈশাখের পোশাক এবং সাজ-সজ্জায় নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। অনেকে ছুটে যান ব্যান্ডসংগীতসহ সুরের মূর্ছনায় যেখানে গিয়ে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এদিন থাকে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ। সবাই একাকার হয়ে উপভোগ করতে চায় সংস্কৃতিকে। আর এটিই হলো বৈশাখের সর্বজনীনতা। এছাড়া বৈশাখীমেলায় সবাই সংসারের প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রীগুলো ক্রয় করতে পারে। বৈশাখী উৎসব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি শহরের এ্যাপার্টমেন্টের নিজস্ব গণ্ডির ভেতরও অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এভাবে সবাই বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করে নিজে যেমন আনন্দ পায়, তেমনি সমাজের সবার সঙ্গে মেলবন্ধনও গড়ে তোলার সুযোগ পায়। আজকাল এরূপ উৎসবের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও, সেখানে প্রবাসীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অংশগ্রহণ করে সংস্কৃতিকে লালন করে থাকেন। এছাড়াও ব্যবসায়ীরা হালখাতার মাধ্যমে নতুন বছরের হিসাবের খাতা খোলেন। তাই বাঙালি নতুন বছরে নতুন করে স্বপ্ন যেমন দেখে তেমনি তার সংস্কৃতিকে লালন করে তুলে ধরে বিশ্বদরবারে।
মো. মাকবুল আহমদ
মোহাম্মদপুর, ঢাকা