
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তীব্র লড়াই সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি দেয়। জাত-পাত ভুলে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও আন্দোলনের ফসল এই নতুন বাংলাদেশ। তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে এক নতুন বিশ্বের, এক নতুন বাংলাদেশের, যেখানে কোনো অন্যায় থাকবে না, থাকবে না কোনো জাত পাত, ধর্ম ও বর্ণের ভেদাভেদ। তবে কিছু অসৎ ও দুষ্কৃতকারীদের জন্য আবারও সমাজে দানা বাঁধছে জাতিবাদ।
ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ১নং গেদুড়া ইউনিয়নে গত ১১ এপ্রিলে দুজন ব্যক্তির জমির দ্বন্দ্বের কারণে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুটি গ্রামের মানুষ। একে অপরের ওপর হামলা, বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে দুটি গ্রামের ২০টির অধিক বাড়িঘর পুড়ে গিয়েছে। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে গ্রামের কতিপয় অসাধু ব্যক্তি ও স্থানীয় নেতারা কারও ব্যক্তিগত জমির বিরোধের জেরে ঘটা সহিংসতাকে জাতিগত সংঘাত বলে প্রচার করে এবং সাধারণ মানুষকে এই সংঘাতে জড়াতে উস্কানি দেয়। যার ফলে জাতিবাদ আবারও মাথাচাড়া দেয়। যেই এলাকার মানুষের বন্ধুত্বে, সৌহাদ্যপূর্ণ সহাবস্থান ও এক অপরের প্রতি ভালোবাসা কারণে জাতিবাদ চাপা পড়েছিল মাটির অতল গভীরে, শান্তির নির্মল বাতাস বইছিল যেই এলাকায়, সেই এলাকার কিছু মানুষের উস্কানির কারণে জাতিবাদ আবারও ছড়িয়ে পড়ে। শান্তি ভুলে একে অপরের প্রাণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। রাস্তায় অন্য জাতির কাউকে পেলে তাকে মারধর তার যানবাহন অর্থ সম্পদ লুটপাট শুরু করে। সেদিনই প্রশাসন উক্ত এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি। কিন্তু পুলিশের অবহেলা ও সঠিক নজরদারির অভাবে রাতে আবারও লুটপাট করে স্থানীয় বাজারে থাকা অন্য জাতির কিছু দোকানপাট। তাতেই রাগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে অন্য জাতির মধ্যে। পুলিশের অবহেলায় সংঘাত আরও বৃদ্ধি পায়।
এই জাতিবাদের ভয়ানক আগুন ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে ও পার্শ্ববর্তী থানার রাণীশংকৈল থানার একটি ইউনিয়নে। প্রতিবাদের নামে মিছিল করে এবং মিছিল থেকে উস্কানি ও মিথ্যে বক্তব্য ফেসবুকে প্রচার এবং ফেসবুকে গুজব ছড়ানো ও সহিংস স্লোগানের কারণে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। কিছু দুষ্কৃতকারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যও মানুষকে মিথ্যে বলে সহিংসতায় জড়াতে উস্কে দেওয়ার কাজ করে। যে কারণে মিছিল ও মিছিল থেকে অন্য জাতির বাড়ি ঘরে ও দোকানপাটে হামলা করে। পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে বাধে সংঘর্ষ। শিক্ষার্থীরা স্কুল যাওয়ার সময়, অন্য জাতির অভিযোগ তুলে, শিক্ষার্থীদের মারধর করার মত জঘন্য কাজ করেছে একটি গোষ্ঠী। জাতিবাদের নামে ভয়াবহ কালো দাগ ফেলে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনে। ফলে নিরাপত্তার অভাবে আর স্কুলে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার পরিবেশ প্রায় নষ্ট করার কাজটিও করছে একটি অসাধু গোষ্ঠী। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী, নারী পুরুষ ও শিশুরা। এখন পর্যন্ত চলা এই সহিংসতায় প্রায় ১০০ এর অধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়। স্থানীয় প্রশাসন সংঘাতময় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। তবুও থেমে থেমে সংঘর্ষ জড়ায় জাতিবাদে অন্ধ ও উগ্র মানুষগুলো। পরে উক্ত এলাকায় বিজিবি মোতায়েন, পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়। জেলা, উপজেলার সকল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের কঠোর তৎপরতার ফলে এলাকাগুলোতে কিছুটা শান্তি বিরাজ করে। ধারণা করা হয়, সব কিছু দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী এখনো মানুষকে উস্কে দিয়ে মিথ্যে তথ্য প্রচার করে আবারও সহিংস পরিবেশ তৈরির পাঁয়তারা করছে।
অঞ্চলটির স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা অতীব জরুরি। গ্রামের নিরীহ মানুষগুলো ভয়ে কাজে বের হতে পারছে না, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে তারা। তাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তৎপরতা প্রয়োজন। ফেসবুকে যারা উস্কানি ও গুজব ছড়িয়ে সংঘাতকে উস্কে দিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব দুষ্কৃতকারী জাতিগত বিবাদকে উস্কে দিয়েছে এবং হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের গ্রেপ্তার না করলে এলাকার পরিবেশ আবারও খারাপ হতে পারে। তাই সকল অপরাধীকে দ্রুত সময়ে গ্রেপ্তার করতে হবে। সর্বোপরি মানুষকে সচেতন হতে হবে কোনো উস্কানিতে পা না দিয়ে নিজেদের বন্ধু ও প্রতিবেশীদের ওপর আক্রমণ চালানো বন্ধ করতে হবে। শুধু আবেগ দিয়ে চিন্তা করে বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। অন্যের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নিজের পরিবার, সন্তান এবং অন্যের পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে কোনো কিছুই অর্জিত হবে না। অর্জন হবে শুধু মামলা, গ্রেপ্তার আতঙ্ক এবং আর্থিক ক্ষতি। তাই ভেদাভেদ ভুলে মানবতা ও মনুষ্যত্বের দিকে ধাবিত হতে হবে। তাহলেই শান্তির নির্মল বাতাস বইবে পুরো অঞ্চল ও দেশজুড়ে।
প্যানেল