
মধ্যপ্রাচ্যে গাজা উপত্যকায় চরম মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। ইসরাইলি হামলায় গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের জীবন ভয়াবহ সংকটাপন্ন। নারী, শিশু, সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ হামলায় প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে প্রতিদিন। এ নিয়ে বিশ্বে তুমুল নিন্দার ঝড় বয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষোভও চলছে। কিন্তু এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ইসরাইলের হামলা বন্ধ হয়নি। গণহত্যা চলছে নিরন্তর। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাসের অবতারণা করতে চাই না এই সংক্ষিপ্ত লেখায়। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নোংড়া খেলায় মানব সভ্যতা বিপন্নপ্রায়। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোসহ জাতিসংঘও যেন এ নিয়ে মশকরা করে চলেছে। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের যুদ্ধবিগ্রহ লক্ষ্য করছে বিশে^র মানবজাতি। যে সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তা আলাপ আলোচনার ভিত্তিতেই সমাধান করা যেত। কিন্তু মানবজাতি বড় নিষ্ঠুর। কেউ কাউকে ছাড় দেওয়ার মতো উদার নয়। সবাই নিজ স্বার্থকে বড় করে দেখে।
উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়েছিল ট্রাম্প হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্যে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কেননা, বিশ্বের একক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকেই স্থান দিয়ে আসছে। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশে^র ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। বিশ^ সামাজিক বাস্তবতায় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই ইচ্ছা করলে অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারেন। কিন্তু সেটা না করে অশান্তিকে উপভোগ্য উপকরণ হিসেবে দেখে থাকেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকারও করেছিলেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা যুদ্ধ এসব বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করার ঘোষণা করেছিলেন। আশ্বস্ত হয়েছিল জনগণ। ইসরাইল-হামাসের মধ্যে গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরের পর বেশ কিছুদিন শান্তি বিরাজ করছিল। স্বজন হারানোর বেদনা ভুলে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেকে নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন শুধুই স্বপ্ন থেকে গেল। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে নতুন মাত্রায় নিধনযজ্ঞ। এর পেছনের যথার্থ কারণ না থাকলেও রহস্য রয়েছে। রহস্যটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গাজা খালি করার পরিকল্পনা। গাজাকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গাজায় অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কথা বলা হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে, গত ৮ এপ্রিল হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। তাদের পারস্পরিক উষ্ণতা দেখে মনে হয়েছিল একটা সমাধান হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। আর এতে ইসরাইলেরও সমর্থন থাকবে। ভবিষ্যতে একটি নিরাপদ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই এর মূল্য লক্ষ্য। যে জন্য গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের নিষ্ঠুর নিধন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ হত্যা, নিষ্পাপ শিশু ও নারী হত্যা করে বিশ্ব সভ্যতাকে কলংকিত করার কোনো অধিকার কারও নেই। ফিলিস্তিনিরা মনে করে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র হওয়া উচিৎ পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ ইসরাইলিও এই ধারণাকে সমর্থন করেন। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন কথিত রাজনীতিক সবকিছু বাদ দিয়ে একটি মাত্র রাষ্ট্র গঠনকে সমর্থন করে। তাদের মতে, সমগ্র ইসরাইল, পশ্চিম তীর ও গাজা মিলে একটি দ্বিজাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হওয়া উচিত। যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। তারা এটাকেই স্থায়ী সমাধান মনে করেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেকেই একে অপরের কোনো কোনো প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।
এখন আসি মূল কথায়। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে মনুষ্যত্ব বিকাশে কাজ করতে হবে। যুদ্ধ কখনো শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারে না। এটা বিশ্ব নেতারা জানেন, তারপরও যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কেন হয়? এ প্রশ্নের উত্তর হবে একটাই, তা হচ্ছে ক্ষমতা জাহির করা। সামান্য ও ঠুনকো অজুহাতে সংঘটিত হচ্ছে যুদ্ধ। এতে নিরীহ মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে। আর নেতারা সিংহাসনে বসে বগল বাজাচ্ছেন। নারকীয় বীভৎস দৃশ্য দেখেও বিশ্ব নেতাদের কোনো বিকার নেই। মানুষের জীবন কত মূল্যবান তা কী নেতারা উপলব্ধি করেছেন? হয়তো করেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মানবজাতি কীভাবে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান করবে কিংবা শান্তিপ্রিয় বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠবে, তা নিয়ে বিশ্বনেতারা কতটুকু ভাবছেন সে প্রশ্নগুলো সামনে আসছে। বড় কঠিন সময়ের মুখোমুখি গোটা বিশ্ব। আমরা মানব জাতি এখন উপায় সম্পর্কীয় মানবিক জ্ঞান ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মানবিক বোকামি, এই দুইয়ের দৌড়ের মধ্যস্থলে রয়েছি। মানুষ যদি বাহ্যজ্ঞানের সমৃদ্ধির সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ না ঘটায়, বাহ্যজ্ঞানের প্রবৃদ্ধি তার দুঃখ-কষ্টের বৃদ্ধি ঘটাবে। এটি হচ্ছে মানব সভ্যতা ক্রমবিকাশের লক্ষ্য। মানব সত্তা তার পার্থিব সম্পদ থেকে মহত্ত্বর- এ সত্য আমরা তখনই বুঝি যখন সংকটে পড়ি।
এ সত্য প্রতিভাত হয়েছে গত বিশ্ব যুদ্ধের সময়। ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্থায়ী ছিল। মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি নামে দুটি সামরিক বলয় তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ জড়িয়ে পড়েছিল। ভয়াবহ এ যুদ্ধে প্রায় ৬ কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছিল। সে সময় ভারতবর্ষেরও বহুলোক ব্রহ্মদেশ অর্থাৎ বর্মার রেঙ্গুনে চাকরি করত। জাপান রেঙ্গুনে বোমা হামলা করেছিল। রেঙ্গুন শহর ছিল সে সময় অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। বোমা হামলার কারণে রেঙ্গুন শহরের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রেঙ্গুন থেকে ভারতীয় বহুলোক স্বদেশে আসতে শুরু করে। রেঙ্গুনের কিছু লোকও ভারতে চলে আসতে থাকে। ভারতীয়দের মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলা, তামিলনাড়ুর নাগরিক ছিল। রেঙ্গুন ছাড়ার সময়, প্রত্যেকেই নিজ নিজ সম্পদের যতটা সম্ভব সঙ্গে করে নিয়ে আসে। নিজ নিজ গৃহস্থালি সম্পদ যেমন- থালা, ঘটি, বাটি, কড়াই, বড় রেডিও, বিছানা, কম্বল ও বহু দামি দামি জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়েছিল। দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন কিছু জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে দেয়। অতীব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে। কিছুদূর যেতে যেতেই আবার কিছু জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে দেয়। এভাবে নিজের পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত সব জিনিসই ফেলে আসতে বাধ্য হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে কেবল প্রাণ ছাড়া অন্য সবকিছুই তাদের কাছে হয়ে পড়ে মূল্যহীন। মানুষের কাছে তার প্রাণের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই, এটা তারই প্রমাণ। জীবনে বেঁচে থাকলে সবকিছুই হয়। চরম সংকটকালে পরম বস্তু একমাত্র মানুষ। তার নিজ অধিকারভুক্ত সম্পদগুলো নয়। মানুষ বেঁচে থাকলে সভ্যতা বাঁচে, সমৃদ্ধ হয় সুন্দর পৃথিবী। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ বিলুপ্তির পথে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে মানবতা যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে তা দেখলে আজ গা-শিউড়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও যান্ত্রিক যোগাযোগের কল্যাণে বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে নারকীয় বীভৎস দৃশ্যগুলো প্রায়ই দেখানো হচ্ছে। মানুষ মানুষের প্রতি এমন বর্বর আচরণ করতে পারে, তা অবিশ^াস্য। রাজনৈতিক নেতাদের যদি চিত্তে শান্তিভাব জেগে না ওঠে তবে শান্তি ফেরে না। নেতারা নানা প্রলোভনের মধ্যে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আধ্যাত্মিক সামর্থ্য না থাকলে মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় না। আধুনিক এই বিজ্ঞান সভ্যতায় মনুষ্যত্বের জ্ঞান যেন বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে। গাজায় নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হচ্ছে জাতি বা সম্প্রদায় বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। জিগির তোলা হচ্ছে গাজায় মুসলমান বা ইসলাম ধর্মের লোকদের হত্যা করা হচ্ছে- বিষয়টি এভাবে দেখলে বিদ্বেষ প্রকটিত হবে। মুসলিম বলে কথা নয়- মানুষরূপী দানবেরা মানুষ হত্যা করছে। এটাই ধ্রুব সত্য। এই বর্বর হত্যার বিরুদ্ধে গড়ে উঠুক প্রতিরোধ। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বেসামরিক সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছে, সেটাও নিন্দনীয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষের সৈনিকের প্রাণ যাবে এটাই যুদ্ধের প্রকৃতি। কিন্তু নারী-শিশু-সাধারণ মানুষ কেন হত্যার শিকার হবে? এই প্রশ্ন তুলতে হবেই বিশ্বকে। গাজা যুদ্ধের জরুরি অবসান হোক। প্রতিষ্ঠিত হোক মানবতা। জেগে উঠুক বিশ্ব নেতাদের বিবেক। নোংড়া অপরাজনীতির বিষাক্ত রসায়নে মানুষকে যেন মরতে না হয়- সেই সংগ্রাম গড়ে উঠুক মানবতার। মানব সভ্যতা কলংকমুক্ত হোক।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
প্যানেল