
১৭ এপ্রিল বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বে এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো রক্ত?সংক্রান্ত রোগ হিমোফিলিয়া সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা। এছাড়াও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক শ্নাবেলকে স্মরণ করার জন্য তার জন্মদিন উপলক্ষে এই দিনটি পালিত হয়। তাই হিমোফিলিয়া কি কেন এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
হিমোফিলিয়া কি?
হিমোফিলিয়া শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ হাইমা এবং ফিলিয়া হতে। হাইমা অর্থ রক্ত এবং ফিলিয়া অর্থ আকর্ষণ। দেহের কোনো অংশে রক্তপাত শুরু হলে সাধারণত সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। মেডিক্যালের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে ক্লোটিং বলে। ক্লটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত জমাট বেঁধে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। সত্য বলতে, আমাদের দেহে কোথাও কোনো ক্ষত তৈরি হলে সেই ক্ষতস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যাওয়াকেই ক্লোটিং বলে। যে পদার্থ রক্তক্ষরণে বাধা দেয় তাকে ক্লোট বলে। কিন্তু কোনো কারণে ক্ষতস্থানে এই ক্লোট তৈরি না হলে সেখান থেকে একাধারে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
একজন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে এই ক্লোট সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নয়। ব্যাপারটি আসলে এমন নয় যে, রোগীর দেহ থেকে অঝোরে এবং খুব দ্রুত রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। মূলত একজন হিমোফিলিয়াক (যারা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত) ব্যক্তির দেহ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। অনেকে হয়তো এমন মনে করছেন যে, এই রোগ হলে হাত, পা, হাঁটু ইত্যাদির কোথাও কেটে গেলেই তা থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকবে। ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। দেহের বাইরের কোনো ছোটখাটো আঘাত এখানে খুব একটা চিন্তার বিষয় নয়। আসল চিন্তার বিষয় হলো ইন্টারনাল ব্লিডিং বা দেহের অভ্যন্তরীণ কোনো অংশে রক্তক্ষরণ। এ ধরনের রক্তক্ষরণকে হ্যামোরেজ বলে। এটি মূলত দেখা যায় দেহের ভিতরে কোনো সন্ধি যেমন হাঁটু ও গোঁড়ালিতে। এ ছাড়া দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন টিস্যু ও পেশির মিলনস্থলেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। দেহের ভেতরে এমন রক্তক্ষরণ অনেক যন্ত্রণাদায়ক হয় এবং আক্রান্ত অংশ বেশ ফুলতে শুরু করে।
হিমোফিলিয়া কেন হয়
মানবদেহে একটি X ও অন্যটি Y ক্রোমোজম থাকলে সে হয় ছেলে (46,XY)। আর যদি দুটিই X ক্রোমোজম থাকে তাহলে সে হয় মেয়ে (46, XX)। X ক্রোমোজমে F8 ও F9 নামক জিন থাকে, যা F-VIII ও F-IX নামক ক্লোটিং প্রোটিন তৈরি করে। এই ক্লোটিং প্রোটিন রক্তের সাদা অংশে পরিমাণমতো থাকে। ফলে আপনা আপনি রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। যাদের রক্তে এই ক্লোটিং প্রোটিন কম থাকে, তাদের রক্ত পড়া বন্ধ হয় না অথবা বিলম্বিত হয়। তারাই হিমোফিলিয়ার রোগী। ছেলেদের দেহে যেহেতু একটামাত্র X ক্রোমোজম থাকে এবং এই একমাত্র X ক্রোমোজম যদি অসুস্থ/defect থাকে, তাহলে F-VIII/F-IX তৈরি হয় না। ফলে ছেলেরাই হিমোফিলিয়ার রোগী হয়। আর মেয়েদের দেহে যেহেতু দুটি X ক্রোমোজম থাকে, তাই একটি X অসুস্থ/defect হলেও অন্য X সুস্থ থাকায় পর্যাপ্ত F-VIII/F-IX তৈরি হয়। তাই সাধারণত মেয়েরা হিমোফিলিয়ার রোগী হয় না, রোগের বাহক হয়। তবে ১. Lyonisation/inactivation of healthy X chromosome হলে, ২. বাবা রোগী ও মা বাহক হলে অথবা ৩. Turner syndrome (45,XO) হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। তাই হিমোফিলিয়ার রোগীর সঙ্গে মামাতো, খালাতো প্রভৃতি বোনের বিয়ে হলে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন হিমোফিলিয়ার রোগীর মধ্যে অন্তত একজন বংশানুক্রমে সঞ্চারিত না হয়ে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়।
হিমোফিলিয়ার প্রকারভেদ
হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ‘বি’ দুই ধরনের। হিমোফিলিয়া-‘এ’-তে, ফ্যাকফোর-৮ মাত্রা কম বা অনুপস্থিত। হিমোফিলিয়া-‘বি’ ফ্যাকফোর-৯ এর ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষেরই হিমোফিলিয়া-‘এ’ আছে। এটি শরীরের ক্রোমোজোম সিস্টেমের অবনতির কারণেও হয়। আর চিকিৎসকদের ধারণা, বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। আর বিশ্বব্যাপী প্রায় চার লাখ মানুষ হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত।
হিমোফিলিয়ার লক্ষণ
যদি কোনো সাধারণ আঘাত বা ক্ষত থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয় তাহলে বুঝবেন এটি হিমোফিলিয়ার কারণে হয়েছে। এই রোগের ক্ষেত্রে রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট, প্রোথ্রোমবিন, প্লাটিলেটের অসুস্থতা ইত্যাদি কমে যেতে পারে। এছাড়াও ক্ষতস্থানে বিলম্বিত রক্তপাত হয়। আর অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বা কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়াটাই হিমোফিলিয়ার মূল লক্ষণ। শিশু বয়সেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ, শরীরের আঘাত লাগলে সেই জায়গাটি নীলচে হয়ে ফুলে যায়। অর্থাৎ চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ, মাংসপেশিতে এবং অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণ, হাঁটু, কনুই ও অন্যান্য অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া, শরীরের কোথাও কেটে গেলে দীর্ঘক্ষণ রক্ত ঝরা, দাঁত তোলার পর বা সুন্নতে খাতনা করার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার সময় হাঁটুতে কালচে দাগ হওয়া, নবজাতকের নাড়ি কাটার সময় দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।
হিমোফিলিয়ার বংশগতি
যদি বাবা সুস্থ ও মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ আর মেয়ে সন্তানের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। বাবা রোগী এবং মা সুস্থ হয় তবে সব ছেলে সন্তানই সুস্থ হবে এবং সব মেয়ে সন্তানই বাহক হবে। বাবা রোগী এবং মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। আর মেয়ে সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ ও বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রোগী বিয়ে করতে পারবে। তবে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সাধারণত শুধু পুরুষরাই এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং নারীরা এই রোগের বাহক। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাবা রোগী ও মা বাহক হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। হিমোফিলিয়া রোগীর সঙ্গে আত্মীয় যেমন খালাতো, মামাতো বা ফুপাতো বোনের বিয়ে হলে দুজনেই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কিছু সতর্কতা চিহ্ন এবং উপসর্গ
* মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ : গুরুতর হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত কিছু লোকের মাথায় সামান্য আঘাতের পরে মস্তিষ্কে রক্তপাত হতে পারে। যদিও এটি প্রায়শই ঘটে না, এটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি।
* চলমান মাথা ব্যথা।
* বারবার বমি হওয়া।
* অলসতা বা তন্দ্রা।
* হঠাৎ দুর্বলতা।
* হৃদরোগের আক্রমণ বা কম্পন।
পরীক্ষা
রক্তের ফ্যাক্টর দুটির পরীক্ষা।
রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা পরীক্ষা।
প্রতিরোধ
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের genetic testing, genetic counseling ও prenatal test (amniocentesis) করে অনাগত সন্তান রোগী না বাহক তা নিশ্চিত হয়ে হিমোফিলিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যায়। দেশেই এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে। হিমোফিলিয়া রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ করানোর কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
হোমিওপ্যাথিতে হিমোফিলিয়া রোগ নির্ণয়
হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নীতি অনুসারে- হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী এতে ব্যক্তির রোগের চিকিৎসা করা হয় না। বরং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা হয়। যার সহজ অর্থ হলো একজন অসুস্থ ব্যক্তির পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, যার ফলে যেকোনো রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটিও বিশ্বাস করা হয় যে, হোমিওপ্যাথি ওষুধের সাহায্যে এমন অনেক রোগের মূল থেকে চিকিৎসা করা যেতে পারে, যা আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। আর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ের প্রক্রিয়া আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। হোমিওপ্যাথি দ্বারা রোগ নির্ণয় করা হয়, যেখানে রোগীর শুধু লক্ষণগুলো পরীক্ষা করা হয় না বরং তার সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। রোগ নির্ণয়ের সময়, রোগীকে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়, যার সাহায্যে ডাক্তার রোগের ধরন এবং এটির কারণগুলোর চিকিৎসা করেন। পরীক্ষার সময়, রোগীর মানসিক অবস্থাও পরীক্ষা করা হয়, যার জন্য তাকে তার জীবন পরিস্থিতি, উদ্বেগ, ভয়, চাপ এবং অন্যান্য মানসিক চাপ ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ের সাহায্যে চিকিৎসকরা রোগীর রোগ ও তার কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কেও জানেন।
পরিশেষে বলতে চাই, রক্তক্ষরণজনিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব সেই প্রাচীনকাল থেকে লেগে আছে। রক্ত সম্পর্কে তৎকালীন মানুষের ধারণা অনেক কম ছিল। ব্রিটিশ রাজপরিবারে যখন প্রথম এই রোগের আলামত পাওয়া যায়, তখন চিকিৎসা পদ্ধতি ততটা উন্নত ছিল না। ১৯০৪ সালে প্রথম রক্তের প্লাজমা আবিষ্কার হয়। এরপর আবিষ্কার হতে থাকে নানা প্লাজমা প্রোটিন, যেগুলোর অনুপস্থিতির কারণে মূলত হিমোফিলিয়া রোগ দেখা দিতে পারে। বংশগত রোগ হওয়ার কারণে এ রোগ সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করার তেমন কোনো উপায় নেই। তবে চিকিৎসা পদ্ধতির উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে এখন এই রোগের আধুনিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এখন দ্রুত হিমোফিলিয়া রোগটি শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তাই হিমোফিলিয়া রোগ নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা।
লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান
জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
[email protected]
প্যানেল