
পবিত্র কুরআনের তৃতীয় ও অন্যতম বৃহৎ সুরা হলো ‘সুরায়ে আল ইমরান’। মদিনায় অবতীর্ণ এ সুরায় ২০টি রুকু ও ২০০টি আয়াত রয়েছে। এই সুরার মধ্যে এক স্থানে ‘আল ইমরান’-এর উল্লেখ করা হয়েছে, চিহ্নস্বরূপ ওটাকে সুরাটির নামরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। অবতীর্ণ হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে কুরআন ব্যাখ্যাকারীগণ মত ব্যক্ত করেছেন যে, এ সুরায় চারটি ভাষণ সন্নিবেশিত হয়েছে।
প্রথম ভাষণ সুরার শুরু হতে চতুর্থ রুকুর প্রথম দু’আয়াত পর্যন্ত। এটি সম্ভবত বদর যুদ্ধের পরবর্তী কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাষণ হলো তৎপরবর্তী ৬ষ্ঠ রুকুর শেষ পর্যন্ত। নবম হিজরিতে নাজরান প্রতিনিধিদের আগমনের সময় এটি নাযিল হয়। তৃতীয় ভাষণ সপ্তম রুকুর শুরু হতে দ্বাদশ রুকুর শেষভাগ পর্যন্ত চলেছে। প্রথম ভাষণের সমসায়িককালেই এটি নাযিল হয়েছে বলে মনে করা হয়। চতুর্থটি ত্রয়োদশ রুকু হতে সুরার শেষ পর্যন্ত। এটি উহুদের যুদ্ধের পরে নাযিল হয়েছে।
এই সুরার বাণীগুলো বিশেষভাবে দুটি দলের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলা হয়েছে। প্রথম আহ্লি কিতাব, ...ইহুদি ও খ্রিস্টান আর দ্বিতীয় মুসলিম সম্প্রদায়Ñ যারা হজরত মুহাম্মদের (সা.) ওপর ইমান এনেছিল। প্রথম দলকে এ সুরায় সুরা বাকারার অনুরূপ পদ্ধতিতে আরও অধিক পূর্ণতাসহকারে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তাদের আকিদার ভ্রান্তি ও নৈতিক ত্রুটি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে : এই নবী এবং এই কুরআন সেই দ্বীনেরই সত্যতা ঘোষণা করছে, যা পূর্ববর্তী সমগ্র নবীগণ মানুষকে বুঝিয়েছেন। এ এক আল্লাহর স্থায়ী বিধান এবং একমাত্র সত্য জীবন ব্যবস্থা। দি¦তীয় দলকেÑ অর্থাৎ যারা মুসলমান, যারা সর্বোত্তম জাতি হিসেবে আখেরি নবীর উম্মত এবং দুনিয়ার মানুষের সামনে সত্যের ধারক-বাহক, তাদের গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের অতীতকালের উম্মতদের ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতনের মর্মান্তিক চিত্র দেখিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের পদাংক অনুসরণ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কীভাবে মুমিনের সামনে আহলি কিতাব ও মুনাফিকরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে এর প্রয়োজনীয় কথা সুরা আল ইমরানে এসেছে।
উহুদ যুদ্ধের সময় আনুগত্যহীনতা ও নির্দেশ ভুলে যাওয়ার মতো যেসব দুর্বলতা কতিপয় মুসলমানদের পেয়ে বসেছিল, এখানে তা সংশোধনের জন্যও উপদেশ দেওয়া হয়েছে। মোট কথা, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবীর (সা.) ঐতিহাসিক মদিনা হিজরতের পর মুষ্টিমেয় মুসলমানদের বদর যুদ্ধে ঈর্ষণীয় বীরত্ব ও কৃতিত্বে কাফির সম্প্রদায়ের যে মোহভঙ্গ হয়েছিল, আহ্লি কিতাবগণ যেভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগল এবং এক পর্যায়ে মুনাফিক চক্রান্ত ও কতিপয় মুসলমানদের দুর্বলতার কারণে উহুদ যুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায় যে গ্লানিকর শিক্ষা পেল, তার চিত্র ও পটভূমি সংরক্ষিত হয়েছে এ সুরায়। মুসলিম জাতির যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় কিংবা শত্রু-মিত্র নির্ণয়ের কালে এ সুরা সর্বদা আলোকবর্তিকার ন্যায় পথ দেখিয়ে থাকে।
বিশেষ করে এ সুরার পটভূমিকায় নাজরান প্রতিনিধিদের যে প্রশ্নোত্তরের ঘটনা রয়েছে, তা আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণের জন্য একটি চিরভাস্বর যুক্তিপূর্ণ আলোচনা হিসেবে অম্লান হয়ে আছে।
একবার আ-হজরত (সা.)-এর সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়ে তাকে হেস্তনেস্ত করার হীন অভিপ্রায় নিয়ে অতি পরিকল্পনা সহকারে নাজরানের ষাট সদস্যবিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের খ্রিস্টান প্রতিনিধি মদিনায় আসেন। তন্মধ্যে ১৪ জন ছিলেন নেতৃস্থানীয় লোক। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আবদুল মসীহ নামের একজন অতীব শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তার মতামতের বাইরে নাসারা সম্প্রদায় কখনো এক পা রাখত না। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বিশ্বস্ত ও ধনী ব্যক্তি আইহাম, নাসারা মুল্লুকের তামাম আলিম ও পাদ্রীদের শিরোমণি রোম বাদশাহদের সম্মানের পাত্র আবু হারেছা ইবনে আরকামা। তারা সবাই সেদিন অতি উত্তম ও দামি পোশাক পরে বেশ শানশওকতের সঙ্গে হুজুর (সা.)-এর সঙ্গে মুনাজেরা (বিতর্ক) করার উদ্দেশ্যে আসেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের সসম্মানে পবিত্র মসজিদে নববীতে বসতে দিলেন। হজরত তখন আছরের নামাজ পড়ছিলেন। নাজরান প্রতিনিধিদেরও মসজিদের পূর্ব কর্নারে তাদের উপাসনা করার সুযোগ করে দিলেন। উভয় পক্ষের ইবাদত আদায় যখন শেষ হলো, তারা পরস্পর সামনাসামনি বসলেন, ভাব বিনিময় করলেন। মহানবী (সা.) যথারীতি তাদের ইসলাম ধর্মে প্রবেশের দাওয়াত দিলেন। তাদের আকিদাগত কিছু ত্রুটি ছাড়া অনেক কিছুই মুসলমানদের তাহজীব-তমদ্দুনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা বললেন, ‘আমরা তো আগ থেকে ইসলামের অনুসারী। যেহেতু আমাদের প্রভু ঈসা (যীশু) আছেন, আমাদের জন্য আসমানী কিতাব আছে।’ হজরত জানালেন, আপনাদের দাবিতে গলদ আছে। কারণ, প্রকৃত ইসলাম (ধর্ম) এ কথা বলতে বারণ করে থাকে যে, আল্লাহর কোনো সন্তান-সন্ততি থাকতে পারে।’ উপরন্তু ‘আপনারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টির উপাসনা করেন, অপবিত্র খাদ্য ভক্ষণ করেন’। তারা প্রশ্ন করলেন : যদি ঈসা আল্লাহর পুত্র না হয়ে থাকেন তাহলে বলুন, তার পিতা কে? কারণ ঈসার জন্মকালীন তার কোনো মনুষ্য পিতা ছিল না, অলৌকিকভাবে জন্ম নেন।
হুজুর (সা.) জানালেন : আপনারা তো জানেনই যে, কোনো সন্তান অবশ্যই পিতার গুণাগুণ, আকৃতি ও স্বভাব চরিত্রের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। তারা স্বীকার করলেন। হজরত আবার বললেন, আপনারা কি জানেন না, আমাদের মহামহিম প্রভু আল্লাহ চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। তাঁর তিরোধান অসম্ভব বিষয়। পক্ষান্তরে, ঈসা নবী তো মৃত্যুপথযাত্রী। তারা তা মেনে নিলেন।
তিনি প্রশ্ন করলেন : আপনারা কি জানেন না, আমার মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব সৃষ্টিকুলের প্রকৃত সংরক্ষক এবং সকলের একমাত্র রিজিকদাতা।
তারা উত্তর করলেন : হ্যাঁ।
এবার হুজুর (সা.) পাল্টা জানতে চাইলেন, হজরত ঈসা (আ.) কি সেই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী?
তারা আমতা আমতা করে স্বীকারই করে নিলেনÑ না, মোটেই না।
হুজুর (সা.) আরও আরজ করলেন : ‘আপনারা কি জানেন না আল্লাহ তায়ালার কাছে আসমান ও জমিনের মধ্যে কোনো কিছু গোপন নেই।’
তারা স্বীকার করল। আ-হজরত বললেন, তো ঈসা কি আল্লাহর দেওয়া জ্ঞান বিনা কোনো কিছু জানতেন? আল্লাহর আখেরি নবী (সা.) বললেন, আপনারা নিশ্চয় জানেন, ঈসা অন্য দশজনের মতো মায়ের গর্ভে ছিলেন, যথানিয়মে শিশুখাদ্য খেয়েছেন ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর, মানবীয় দুর্বলতার কারণে প্রকৃতির ডাকে সাড়াও দিতেন। তারা তাও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। আ-হজরত এবার সবিনয়ে জানতে চাইলেন যে, এতকিছুর পরও ঈসা (আ.) কিভাবে প্রভু কিংবা প্রভুর আওলাদ হতে পারেন? যেমনটি আপনারা ধারণা করে চলেন? বস্তুত ঈসা (আ.) তো আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও রাসুল। এতে জামানার মহান পয়গাম্বরের সামনে নাজরান প্রশ্নবাজ পণ্ডিতগণ নির্বাক, নিরুত্তর হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির জন্য, নবী- রাসুলগণের মর্যাদা বুঝার জন্য বিশেষ করে ঈসা নবীর (আ.) মর্তবা পরিমাপের জন্য সুরা আল ইমরানের প্রথম দিকের প্রায় আশি আয়াত হজরত জিব্রাঈল ফেরেস্তার মাধ্যমে হুজুরে পুর নূর (সা.)-এর কাছে নাযিল করেন। হজরত রাসুলে কারিম দুনিয়ার মানুষকে আল্লাহর পবিত্রতা সম্পর্কে শিক্ষাদান করেন।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]
প্যানেল