ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

সরকারি কাজে হয়রানি

শহিদুজ্জামান শাকিল

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

সরকারি কাজে হয়রানি

সরকারি প্রশাসনিক কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত করে যে, কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে ও নিয়মমাফিক সম্পন্ন হচ্ছে এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তের মধ্যে অস্থিতিশীলতা বা অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হচ্ছে না। তবে যখন এই ধারাবাহিকতার নামে সাধারণ মানুষদের হয়রানি এবং জরুরি কাজগুলো অবহেলিত হয়, তখন এ ধারাবাহিকতা আর প্রশংসার দাবি রাখে না। সরকারি কাজের প্রক্রিয়া বহুস্তরীয় এবং জটিল হলেও এর লক্ষ্য একটাই- সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সম্পন্ন করা। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় অনেক সময় দেখা যায়, যে কাজগুলো সহজে এবং দ্রুত সমাধান করা সম্ভব, সেগুলো সম্পন্ন হতে অনেকটা সময় নেয়। অফিসের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরে, এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে দৌড়াতে গিয়ে জনগণ শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। আর এর মাঝে যখন কর্তৃপক্ষ সময়ক্ষেপণ বা নিয়মের সীমিত প্রক্রিয়ার শৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে জনগণকে হয়রানির শিকার করে, তখন সেটা শুধু সিস্টেমের ব্যর্থতা নয়, বরং নৈতিকতারও অভাব।
আমরা জানি, কোনো কাজের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যতই জরুরি হোক না কেন, সেটা যদি মানুষের সময়ের অপচয় এবং অযাচিত দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তবে তার কোনো তাৎপর্য থাকে না। বিশেষত যখন কোনো কাজকে অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করা সম্ভব, তখন সেটা যদি দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয় তবে তা জনগণকে হতাশ করে। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থাকে যদি কাজটি দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয়, তবে কেন সেই কাজটির জন্য এত সময় নেওয়া হয়? দুর্ভাগ্যবশত, অনেক সরকারি দপ্তরে এ দীর্ঘসূত্রতার কারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং সৃষ্ট অকারণ জটিলতা। এর পাশাপাশি, উৎকোচের মাধ্যমে কাজ সমাধান করার বিষয়টি আরও বড় একটি সমস্যার সৃষ্টি করে। সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সাধারণ মানুষের যে আস্থা থাকা উচিত, সেটি এ ধরনের অনৈতিক আচরণের ফলে ক্ষুণ্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশে সরকারি দপ্তরগুলোতে কাজের দীর্ঘসূত্রতা একটি পরিচিত সমস্যা, যা প্রায়ই উৎকোচ গ্রহণের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনৈতিক সুবিধা লাভের আশায় ফাইলের অগ্রগতিতে অযথা বিলম্ব ঘটান। বিআরটিসি-তে ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেখানে দালালদের মাধ্যমে উৎকোচ প্রদান ব্যতীত দ্রুত সেবা পাওয়া দুষ্কর। খুব কম সংখ্যক লোকই হয়তো পাওয়া যাবে যারা উৎকোচ প্রদান করেনি। এভাবে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে অনেক সময় অদক্ষ লোকও ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যায়। যে কারণে বহির্বিশ্বের অনেক দেশেই এদেশের মানুষের ড্রাইভিং লাইসেন্স তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। একই চিত্র ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অফিসসহ অন্যান্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানেও বিদ্যমান। জমির নামজারি, পাসপোর্ট তৈরি কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরকারি কাজ সময়মতো সম্পন্ন না হওয়ায় সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হন এবং বাধ্য হয়ে উৎকোচের পথ বেছে নেন। এই দীর্ঘসূত্রতা একদিকে যেমন জনগণের ভোগান্তি বাড়ায়, অন্যদিকে সরকারি সেবার মান ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে আনে।
প্রকৃতপক্ষে, সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব হলো জনগণের সেবা প্রদান করা এবং তাদের দুর্দশার সমাধান করা। কিন্তু যখন কেউ দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে জনগণের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে, তখন সেটি শুধু একটি ব্যক্তিগত দুর্নীতির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত কার্যকরী এবং দ্রুত কাজ সম্পাদনের জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন করা। এই নীতির আওতায় যেন জনগণকে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দপ্তরে না যেতে হয় এবং তাদের সমস্যার সমাধান একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়। পাশাপাশি, সরকারি দপ্তরের প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সততা এবং পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে এবং পদচ্যুত করতে হবে। পরিশেষে, সরকারি কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যেমন জরুরি, তেমনি সেই কাজের দ্রুত সমাধানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের দুর্ভোগ কমাতে, তাঁদের অধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে এবং জাতীয় উন্নয়নের জন্য একটি সুষম এবং দায়িত্বশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিকাশ জরুরি। সরকারকে অবশ্যই এই বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যা মানুষের স্বার্থে কার্যকরী, সময়োপযোগী এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

×