ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

পরিবর্তনশীল বিশ্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

নুসরাত জাহান রুবাইয়া

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

পরিবর্তনশীল বিশ্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কেবল কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি হয়ে উঠেছে অর্থনীতি, নিরাপত্তা, জলবায়ু ও মানবিক বিষয়াবলির এক জটিল ছক। বাংলাদেশও এই ছকে নিজেদের অবস্থান খুঁজে নিয়ে কিভাবে প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক পরিসরে টিকে থেকে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা তার আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সম্পর্কের উন্নতি ও শক্তিশালীকরণে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া শেখ হাসিনা পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি জটিল ও পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিবেশে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, ইউনূস সরকার কীভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং কোন কোন কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবিলা করতে হবে?
প্রথমত, ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর একটি সংযোগস্থলে অবস্থান করছে। চীনের সঙ্গে বিভিন্ন বিনিয়োগ এবং ভারতের সাথে দ্বিমুখী সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এই ক্ষেত্রে সীমান্ত সমস্যা, পানিবণ্টন ইস্যু ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের দমন-পীড়নের পর প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য চিহ্নিত করলেও রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রত্যাবাসনের পথে বড় বাধা। এর মাঝে নতুন করে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে বর্তমানে এই সমস্যাটি শুধু মানবিক নয়, বরং বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতার একটি বড় পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।
তৃতীয়ত, পানি ভাগাভাগি ও সীমান্ত সমস্যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। তবে তিস্তা চুক্তি এবং সীমান্ত সমস্যা এখনো সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয়নি। এই সমস্যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্লাবিত হচ্ছে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক জলবায়ুনীতিতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বাণিজ্য বৈচিত্র্য না থাকার কারণে বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কৌশল তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে, যা দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যগুলোকে অর্জনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭% শুল্কারোপ করেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো, বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮০% এরও বেশি অবদান রাখে এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। এই নতুন শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যেমন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে, তেমনি কিছু সম্ভাবনাও রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে পারে।
বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পরিবহন কাঠামোয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং আন্তঃআঞ্চলিক অবকাঠামো প্রকল্পে সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশের আন্তর্জাতিক ভূমিকা বাড়াতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন উৎপাদন খাত, বিশেষত তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, ওষুধ ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি শক্তিশালী হচ্ছে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলসীমা এক বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্রসম্পদ আহরণ, মৎস্যশিল্প সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার সুযোগ রয়েছে। যা দেশের আন্তর্জাতিক ভূমিকার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আবার, শান্তিরক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগিতার নতুন দরজাও খুলে দিতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর যে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করেছে, এর ফলে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন বাজারে প্রবেশ আরও সহজ হতে পারে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি ও নতুন বাণিজ্যক পথ সুগম হতে পারে। এসব সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে পররাষ্ট্রনীতি কেবল বিশ্বে দেশের অবস্থানকে মজবুত করবে না, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, তা কেবল দেশের কূটনৈতিক কার্যক্রমের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক অবস্থান রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সঠিক কৌশল, দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম। যদি সম্ভাবনাগুলোর সঠিক ব্যবহার করা যায়,বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি তার আঞ্চলিক শক্তির অবস্থান নিশ্চিত করতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে আরও সফল হতে পারবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×