ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

লুটতরাজ নৈরাজ্যের ভাষা

হযরত হানিয়া

প্রকাশিত: ২০:৫০, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

লুটতরাজ নৈরাজ্যের ভাষা

বিশ্বব্যাপী ‘দ্য ওয়ার্ল্ড স্টপ্স ফর গাজা’ শিরোনামে আহ্বানকৃত আন্তর্জাতিক ধর্মঘটে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাংলাদেশ সর্বদা একটি স্পষ্ট নৈতিক অবস্থানে থেকেছে। ১৯৭৮ সালেই ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে (পিএলও) রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া, ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনিদের হয়ে লেবান ইসরাইল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, ফিলিস্তিন ও তার মুক্তিকামী জনগণের সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশ করা এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে আসাও দৃঢ় অবস্থানেরই প্রমাণ। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ফিলিস্তিনের মানুষের একটি ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ রয়েছে। এই সংহতির মূলেই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা, মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে দায়বদ্ধতা এবং মানবিক মূল্যবোধ।  দুঃখজনকভাবেও সত্য যে, সংহতি কর্মসূচি কিছু স্বার্থান্ধ বোধশক্তি বিবর্জিত বিচ্ছিন্ন একাধিক গোষ্ঠী দেশের পরিচালিত কয়েকটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। এসব ঘটনা বয়কট আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ ও নৈতিক চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং একইসঙ্গে চলমান আন্দোলনের মর্ম অর্থে সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সাংঘর্ষিক। এ ধরনের বিকারগ্রস্ত সহিংসতা বাংলাদেশের আইনি কাঠামো, সামাজিক শৃঙ্খলা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং আন্দোলনের উদ্দেশ্য, সবকটিরই পরিপন্থি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সহিংস হামলা বিরল এবং স্পষ্টভাবেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। একদিকে যেখানে মানুষের ইসরাইল-সমর্থক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্ষোভ স্বাভাবিক, অন্যদিকে উন্মত্ততা ও সহিংসতা আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনবে। আন্দোলন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আন্দোলনের পবিত্রতা নষ্ট হবে। বিশেষ করে এমন সময় এ ঘটনা ঘটেছে, যখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করেছে। তখন এই সহিংসতা দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে সরাসরি আঘাত করছে। যা আন্দোলনের মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য ক্ষতি বৈকি উপকার নিয়ে আসবে না। এখানে একটি বাস্তব সত্য হলো এই যে, বয়কট আন্দোলনের সফলতা তখনই আসবে, যখন এর সমান্তরালে কার্যকর ও বিকল্প কাঠামো তৈরি হবে। এখনো বহু ক্ষেত্রেই ইসরাইলি অথবা সমর্থনকারী পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ও প্রযুক্তির বাস্তব বিকল্প বিশ্বের সামনে নেই। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তথা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর গবেষণা, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে শুধু প্রতীকী বয়কট নয়, বরং আত্মনির্ভরশীল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলাও মৌলিকভাবে জরুরি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আন্দোলনকারীদের দায়িত্ব কেবল গর্জে ওঠা কিংবা কেবল প্রথাগত বয়কট করাই নয়, বরং বিকল্প গড়ে তোলাও। বয়কটের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করাতে না পারলে আন্দোলন বারবারই শুধু আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই রয়ে যাবে। আর কোনোভাবেই এ ধরনের সহিংস কার্যক্রমে গিয়ে আন্দোলনেকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না বরং যারা সহিংসতায় অংশগ্রহণ করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। মব সৃষ্ট কোনো কাজই সর্বদায় সফলতার অন্তরায়।

আজিমপুর, ঢাকা থেকে

×