ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

মব জাস্টিস বর্বরতার সংস্কৃতি

এ আর সালাউদ্দিন ফেরদৌস

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

মব জাস্টিস বর্বরতার সংস্কৃতি

সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘মব জাস্টিস’ নামক একটি ভয়াবহ সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে উত্তেজিত জনতা নিজেরাই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা, মারধর বা লাঞ্ছিত করছে। এটি কোনো বিচার নয়, বরং আইনের শাসনকে পদদলিত করার একটি বর্বর প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত এই বর্বরতার ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের সমাজের জন্য এক গভীর সংকটের ইঙ্গিতবাহী।
মব জাস্টিসের ধারণা নতুন নয়। ইতিহাসে বহুবার এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে মানবসভ্যতা। শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকেও দেখা যায়, উত্তেজিত জনতা ভুলবশত একজন নিরীহ কবিকে হত্যা করেছিল শুধু তার নামের মিল থাকার কারণে। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল মূলত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেওয়ার মধ্য দিয়ে, কিন্তু এখন এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা ব্যক্তিগত বিদ্বেষের রূপ নিয়েছে।
এই অপসংস্কৃতি বেড়ে চলার পেছনে রয়েছে নানান কারণ। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও অকার্যকরতা তার মধ্যে অন্যতম যা মানুষকে অধৈর্য করে তোলে। তাই মানুষ এখন নিজেরাই বিচার করতে চায়। তাছাড়া কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক ফায়দা লাভের আশায় ইচ্ছাকৃতভাবে এই অরাজকতাকে উসকে দেয়, যাতে তারা অস্থিরতার সুযোগে ক্ষমতা দখল বা প্রতিপক্ষকে দমন করতে পারে। অন্যদিকে ফেসবুক বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হওয়া বিভ্রান্তিকর বা একতরফা খবর দ্রুত জনগণকে উত্তেজিত করে তুলে, যা মব জাস্টিসকে আরও উস্কে দেয়।
মব জাস্টিসের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এতে অনেক নির্দোষ মানুষের মৃত্যু হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল চোর সন্দেহে তফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যা করার কথা বলা যায়। তাছাড়া যখন জনতা নিজের হাতে বিচার করে, তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। এটি একটি অরাজক সমাজের দিকে ধাবিত করে। অপরদিকে আন্তর্জাতিকভাবেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, যা বিনিয়োগ ও পর্যটন শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
এই বর্বর সংস্কৃতি রোধ করতে হলে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১. মব জাস্টিসে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ ও প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। ২. গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে হবে যে, আইন নিজের হাতে নেওয়া কোনো সমাধান নয়। ৩. দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ আদালতের ওপর আস্থা রাখতে পারে। ৪. রাজনৈতিক নেতাদের অনুসারীদের সংযত রাখা এবং সহিংসতা না ছড়ানো ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
মব জাস্টিস কোনো বিচার নয়, এটি একটি পাশবিক সংস্কৃতি, যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এটি রোধ করতে সরকার, প্রশাসন, মিডিয়া এবং সাধারণ নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আইনের শাসনই একমাত্র আলোকবর্তিকা, যেখানে ন্যায়বিচারের নির্মল প্রভা প্রতিটি মানুষের দুয়ারে পৌঁছাতে পারে। জনতার উত্তপ্ত রোষ ক্ষণিকের দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু তা কেবল ধ্বংসের পথ দেখায়, সুবিচারের শীতল স্পর্শ সেখানে অধরা থেকে যায়। তাই আসুন, মব জাস্টিসকে না বলি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে

×