ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন

মো. ইশতিয়াক হোসেন রাতুল

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান কেবল একটি শাসনব্যবস্থার পতন নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের গ্লানিকর অস্থিরতার বিরুদ্ধে জনগণের এক গণজাগরণ। এ দেশের মানুষ এবার প্রশ্ন তুলেছে শুধু ভোট দিলে কি চলবে? নাকি রাষ্ট্রকে মানুষের জন্য সত্যিকার অর্থে দায়বদ্ধ হতে হবে? এই নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখন আমরা এক নতুন সন্ধিক্ষণে। একটি মানবিক, সমতাভিত্তিক, ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণে সবচেয়ে জরুরি দুটি খাত- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এ খাতে বাস্তব, টেকসই ও নীতিগত বিনিয়োগ ছাড়া “নতুন বাংলাদেশ” কেবল স্লোগানেই থেকে যাবে।
বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের মাত্র ১.৮৭ শতাংশ ব্যয় হয় শিক্ষা খাতে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই সবচেয়ে কম। সরকারি বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ২৬ শতাংশ শিক্ষক পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। যার ফলে মানসম্মত শিক্ষার পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার হার এক শতাংশেরও নিচে এবং অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা তহবিল অনুপস্থিত। এই পরিস্থিতি আমাদের একটি ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে- যেখানে প্রজন্ম পর প্রজন্ম শুধু ডিগ্রি অর্জন করবে, কিন্তু অর্জিত জ্ঞান দিয়ে রাষ্ট্রকে কিছু দিতে পারবে না।
শিক্ষা খাতে আরেকটি দুঃখজনক দিক হলো, বেসরকারিকরণ এবং বৈষম্যের লাগামহীন প্রসার। শহরের কিছু শিশু বিশ্বমানের স্কুলে ইংরেজি ও প্রযুক্তিনির্ভর পাঠ গ্রহণ করছে। সেখানে গ্রামের একটি স্কুলে স্বাস্থ্যকর টয়লেট পর্যন্ত নেই। শহরের বাবা-মা সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে পারছেন বিশাল খরচ দিয়ে। কিন্তু গ্রামের বাবা-মা সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর আগেই ভাবছেন টিফিনের খরচ, খাতা-কলমের দাম কীভাবে জোগাবেন? বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খরচ গত এক বছরে বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ গুণগত মানে নেই তেমন কোনো উন্নয়ন।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা খাতে অন্তত ৬ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ল্যাব, পাঠাগার ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রিসার্চ গ্রান্ট চালু করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি পার্টনারশিপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তবমুখী জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রোগ্রামগুলো জেলা পর্যায়ে বিস্তৃত করতে হবে যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং বিদেশগামী কর্মীরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
স্বাস্থ্য খাতের চিত্র আরও করুণ ও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের প্রতি ১০ হাজার জনগণের বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র ৫.৮ জন এবং নার্স আছেন মাত্র ৩.৭ জন। যেখানে WHO মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজন কমপক্ষে ২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী। প্রতি বছর প্রায় ৬৭ লাখ মানুষ চিকিৎসার খরচ সামলাতে না পেরে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর ৪৩ শতাংশ যন্ত্রপাতি এখন পুরনো ও অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যা দুর্বল ব্যবস্থাপনার একটি স্পষ্ট নিদর্শন।
বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা এখনো ৮০ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো নগরকেন্দ্রিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ৫৫ শতাংশ পদেই চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন। ফলে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি বা অপ্রশিক্ষিতদের কাছে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর হার এখনো প্রতি এক লাখে ১৬৭ জন, যা ঝউএ লক্ষ্যমাত্রার অনেক বাইরে অবস্থান করছে।
এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ৮-১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় ২৪ ঘণ্টার কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি একটি কার্যকর স্বাস্থ্য বিমা স্কিম চালু করা জরুরি, যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চিকিৎসার খরচে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত না হয়। দেশের অভ্যন্তরে মেডিকেল যন্ত্রাংশ ও ওষুধ উৎপাদন বাড়াতে স্থানীয় শিল্পকে প্রণোদনা দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতি ও অপচয়মুক্ত করতে স্বাধীন নিরীক্ষা সংস্থা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
২০২৪ সালের গণআন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে- রাষ্ট্র কি শুধুই প্রশাসনের কাঠামো, নাকি নাগরিকের কল্যাণের জন্য দায়বদ্ধ এক সামাজিক চুক্তি? শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সূচনাবিন্দু। যদি আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্র চাই, তবে তা হবে ‘সেবার গণতন্ত্র’, ‘সুবিধার গণতন্ত্র’, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিককে ন্যূনতম নিরাপত্তা, সুযোগ এবং মর্যাদা দেবে।
আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামীর রাষ্ট্রচিত্র। শুধু মেগা প্রকল্প, উন্নয়নশীল দেশের স্ট্যাটাস বা GDP প্রবৃদ্ধি দিয়ে একটি জাতি বিচার হয় না। বিচার হয় সেই জাতির নাগরিকদের মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে। সেই মর্যাদা আসে উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে। নতুন বাংলাদেশ যদি সত্যিই একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং টেকসই রাষ্ট্র হতে চায়, তবে আজই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন আবারও রয়ে যাবে অতীতের মতো একটি অপূর্ণ প্রতিজ্ঞার স্মারক হয়ে।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

×