
.
পুরানোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেওয়াই মানুষের সহজাত প্রবণতা। এই প্রবণতা বাঙালির মধ্যেও রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ পুরানো ও সমৃদ্ধ। বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। সমৃদ্ধ এই সংস্কৃতির সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসব নিবিড়ভাবে জড়িত। বাংলা নববর্ষ যেমন সুর ও সংগীতের, মেলা ও মিলনের, আনন্দ অবগাহনের, তেমনি সাহস ও সংকল্পের। নতুন প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যাশায় বুক বেঁধে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় বাংলা নববর্ষ। বৈশাখের স্পর্শে যেন আনন্দের কোলাহল জেগে ওঠে দেশের সর্বত্র। এক প্রাণচাঞ্চল্যে দুর্দমনীয় গতির ঘোড়ায় চড়ে আসে বৈশাখ। এসেই তোলপাড় শুরু করে।
ফলে বৃক্ষ থেকে বাতাস পর্যন্ত অন্যরকম দোলায় দুলতে থাকে। প্রকৃতি যেন ব্যস্ততায় মেতে ওঠে। স্বাগত জানায় বৈশাখী নবআনন্দের দিনকে। মানুষ পরিবর্তন ভালোবাসে। এক জায়গায় কিংবা এক রকমের গতি মানুষের সব সময় ভালো লাগে না। নিত্যদিন মানুষ নতুনের সন্ধান করে। মানুষের এ চাওয়াও চিরকালীন। প্রতিটি দিনকে মানুষ আলাদা করে দেখতে ভালোবাসে। আলাদা আয়োজনে উদ্যাপন করতে চায় জীবনের প্রতিটি সকাল। যেভাবেই হোক মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন আলাদা, প্রতিটি সকাল আলাদা, প্রতিটি দুপুর কিংবা সন্ধ্যা অথবা রাত আলাদা। গতকালের সমস্ত বৈশিষ্ট্য গতকালেই থেকে যায়। চলে যায় অতীত নামক মহাসমুদ্রের দিকে। আজ যা ঘটে তা আগামীকাল কিছুতেই ঘটে না। এভাবে মানুষের জীবনে বদলে যায় সব। নতুন হয়ে আসে সব কিছু। সেই নতুনকেই আহ্বান জানায় বৈশাখ। সেই নতুনত্বকেই নিয়ে হাজির হয়।
তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালি তার শিকড় অনুসন্ধান করে নতুনভাবে সাজায় বাংলা নববর্ষের উৎসবকে। সুদীর্ঘ ৫৬ বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে ইতোমধ্যে। রমনা বটমূলের ছায়ানটের নববর্ষ উদ্যাপন সারাদেশ ও বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন জামাকাপড় পরে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি জানান দেয় বাঙালির অস্তিত্বের। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধারণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা ‘ছায়ানট’ (১৯৬১)-এর। ছায়ানট সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি রমনার বটমূলে ১৯৬৭ সাল থেকে চালু করে নববর্ষের উৎসব। এ উৎসব বাঙালির জাতিসত্তার সঙ্গে যুক্ত বলেই দ্রুত তা জনপ্রিয় হয় এবং প্রতি বছরই বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রাণের উৎসব হয়ে ওঠে। নানা ডিজাইনের রং-বেরঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা-শাড়িতে সজ্জিত বাঙালি পুরুষ-নারীর বিপুল সমাগমে এ উৎসব এখন বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে।
এখন এ উৎসব রাজধানী ছাড়িয়ে বিভাগ, বিভাগ ছাড়িয়ে জেলা, জেলা ছাড়িয়ে উপজেলা এবং গ্রাম পর্যন্ত নবআঙ্গিকে এবং নবসাজে চালু হয়ে গেছে। এই উৎসব বাঙালি জীবনে যে অপার আনন্দ বয়ে আনে তার তুলনা বিরল। জীবন তৈরি হয় স্থান, কাল ও পাত্রের চালচিত্রে। আর জীবন এক জায়গায় থেমে থাকে না। সমাজের মানুষ জ্ঞাতসারে কী অজ্ঞাতে পাল্টাতে পাল্টাতেই এগিয়ে যায়। কালের স্রোতে মানুষের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন হয়, সামাজিক আচরণ ও অভ্যাসে আসে ভিন্নতা, শিল্পের সাধনায় বৈচিত্র্য দেখা দেয়, মোড় বদল ঘটে। খাদ্যের অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাস্তু নির্মাণ, ভাষা, ধর্ম, সামাজিক সংস্কার, এমনকি কুসংস্কার এবং মনের গড়ন ও কল্পনার ধাঁচ সবই একটি জাতির সাংস্কৃতিক উপাদান।
কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ার কারণে উৎসব-পালাপার্বণের সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। জীবনকে বাদ দিয়ে তাই সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে অনেকে নববর্ষের উন্মাদনায় বাউল বা বৈরাগীর বেশ ধারণ করে। কিন্তু যারা কঠোর পরিশ্রম ও মেহনত করে, ঘাম ঝরিয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঝড়ঝাপটা, বন্যা-খরা-দুর্যোগ সামাল দিয়ে মাঠে ফসল ফলান সেসব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের খবর আমরা কজনে জানি বা রাখি। যারা দেশ, জাতি ও সমাজের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দেন তারা আমাদের কৃষক জনগোষ্ঠী। বাংলা নববর্ষের এ লগ্নে একবারও কি ভাবা যায় না কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরা কেমন আছেন? উৎপাদন ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? তবে এটা ঠিক যে, বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি কিংবা বাংলা ঋতুর কথা প্রায় ভুলেই যেত। দেশ ও জাতির মঙ্গলে জনগণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, খুলে যাক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার, বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক বাংলা নববর্ষে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
প্যানেল