
.
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপব শুরুর প্রায় একশ’ বছর আগে সাভারের ‘উলাইল’ গ্রামে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার জন্মে ছিলেন । তার জন্মের ঠিক একশ’ বছর পরের সাভার যখন শহর ঢাকার উপকণ্ঠে এক থানা ‘শহর’ তখনো আসলে গ্রামই সে। শিল্পের ছোঁয়া দূরে থাক নগরায়ণের প্রক্রিয়াই বলতে গেলে শুরু হয়নি। সামন্ত সমাজের প্রায় সব লক্ষণ নিয়ে সাভার থানার প্রাণকেন্দ্র বাজার স্ট্যান্ড, থানা রোড, গেন্ডা, কাতলাপুর, উলাইল তখন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শান্ত-স্নিগ্ধ নিবাস। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে অল্প ঘরদোর। মানুষজন প্রায় চোখেই পড়ে না। ঘাসে ছাওয়া লালমাটিতে ঘন বুনটের কাঁঠালগাছের গাঢ় সবুজ রং, সন্ধ্যায় ধলেশ্বরীপাড়ের আলো-আঁধারিতে পাখিদের কিচিরমিচির, আম-পেয়ারা-অরবড়ই-করমচার বাগানে উদাস দুপুর আর যতদূর চোখ যায় খোলা মাঠের ওপর ঝকঝকে আকাশ। সাভার মানেই যেন জলরঙে আঁকা নিখুঁত এক ল্যান্ডস্কেপ। যে সৌন্দর্য বাঁধা পড়ে আছে রুপালি পর্দার অসংখ্য দৃশ্যে। বাংলা চলচ্চিত্রের দৃশ্য নির্মাণ এক সময় এখানে ছিল নিয়মিত। এ সৌন্দর্যের টানেই সম্ভবত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের সূত্রে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকেই জমি কিনে এখানেই স্থায়ী হয়েছেন। শৌখিন বাড়িঘর বানিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে ছন্দময় জীবনযাপন করেছেন। যে প্রক্রিয়ায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানারা মাটি ফুঁড়ে শূন্যে হাত বাড়ায় তার সঙ্গে সাভারের তখনো পরিচয় হয়নি। পরিচয় হয়নি দেশী পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্ত হওয়া ও নতুন এক শ্রমিকশ্রেণি উদ্ভবের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। এসবই হয়েছে গত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় যখন জেনারেল শাসকদের দোর্দ- প্রতাপ শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ‘কাঠামোগত সংস্কার’-এর অংশ হিসেবে আশির দশকের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়শ’ পঞ্চাশটি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সে সময়ের সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ। উনিশশ’ বিরাশি সালের ৩০ নভেম্বর একদিনেই দশটি এবং পরের মাসে আরও তেরোটি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই জেনারেলের প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে দুর্নীতিরও বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছিল। সাভারের নামের সঙ্গে ‘উপজেলা’ শব্দটি যোগ হওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আরও অনেক কিছু। আজকের সোহেল রানাদের পূর্বপুরুষরা ওই আশির দশকেই ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছিল। রানা প্লাজা ধসের ঘটনা তাই শুধু ওই একদিনের একটি ভবন ধসের ঘটনা নয়; বছরের পর বছর ধরে চলে আসা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানান অসঙ্গতির ফল। সাভারও শুধু একটি থানা বা উপজেলার গল্প নয়, সমগ্র বাংলাদেশের এক খ-িত চিত্র।
একাত্তরে যে নতুন রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছিল শাসকশ্রেণি হিসেবে বাঙালির সেখানেই প্রথম আত্মপ্রকাশ। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো যেন ঘটে গেল অনেক কিছু। অনেক ধরনের সুবিধা এলো। বিত্তবৈভবে শ্রেণিউত্তরণ ঘটল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা শাসকগোষ্ঠীর। কয়েক বছরের মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ার হার যেমন দ্রুত গতিতে হলো তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রের চরিত্রেও দ্রুত পরিবর্তন এলো। সন্ত্রাস, নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের সীমাহীন সুযোগ, ভূমি দখল, বিদেশী সাহায্য ও কমিশন ভোগের সুবাদে একটি গোষ্ঠী দ্রুত সম্পদশালী হলো। নিজেদের সম্পদ, প্রতিপত্তি বাড়াতে দেশ-বিদেশের নানা শক্তির সঙ্গে আপোস ও সুবিধাবাদের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া তাঁরা পাড়ি দিয়ে এসেছে সেই প্রক্রিয়া বাজার অর্থনীতি ও তথ্যপ্রবাহের ব্যাপক বিস্তারের সঙ্গে আরও বহুমাত্রিক রূপ পেয়েছে। এ পথের নানা অলিগলিতে জন্ম নিয়েছে হাজার-কোটি সোহেল রানা। সোহেল রানাদের জন্ম এমনি এমনি হয় না। লুটেরা, দখলবাজ, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার শীর্ষে যাওয়ার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে তাদের জন্ম ও বৃদ্ধি। ক্ষমতার লেবাস সামরিক কি বেসামরিক তা বড় কথা নয়, এখানে তাদের চরিত্র অভিন্ন।
যে প্রক্রিয়ায় সোহেল রানারা ভূমিমালিক বা বহুতল ভবনমালিক হন সে প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিউলি, রেশমা, পাখি, শেফালি, রমজানরা ভূমিহীন হয়ে সেলাইকলে নিজেদের ঠিকানা খোঁজেন। তাদের আগমনে বদলে যায় সাভার। স্নিগ্ধ গ্রামীণ আবহে লাগে শিল্পের ছোঁয়া। তবে কারখানার সাইরেনে সাভারের বাতাস কেঁপে উঠলেও মালিক শ্রমিক আর উদ্বৃত্ত মূল্যের দ্বন্দ্বে সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ স্বাভাবিক পথে এগোয় না। শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সমাজ বিকাশের যে ব্যাকরণ শিখিয়েছে তার সঙ্গে মেলে না বাংলাদেশের শিল্প বিকাশের বাস্তবতা। এদেশে পোশাক শ্রমিকদের নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞতা যতখানি মালিক শ্রেণির পেশাদারিত্বের অভাবও ঠিক ততখানি। নইলে যাদের ওপর ভর করে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের এত সুখ্যাতি বা গ্রহণযোগ্যতা তাদের এমন অমানবিক পর্যায়ের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রেখে কাজ করাতেন না। পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকের সম্পর্ক অনেকটাই কৃত্রিম। রাষ্ট্রের সহায়তায় রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশ ঘটেছে, প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে অন্যান্য উৎপাদনশীল খাত ভেঙে পড়েছে। আশির দশক থেকেই এদিকে সরকারি মনোযোগ নিম্নমুখী, ব্যক্তি উদ্যোক্তাদেরও তেমন আগ্রহ নেই। আগ্রহ বেড়েছে মার্কেট, সুপার মার্কেট বা বহুতল ভবন নির্মাণের দিকে। একদিকে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে সুপার মার্কেট, বেসরকারি ব্যাংক-বিমা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল।
দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার যে সুযোগ স্বৈরাচারী এরশাদ করে দিয়েছিলো সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মূল ভূমিকা রাখছে। তারপরও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। একসঙ্গে এগারোশ’ পঁচিশ শ্রমিক অপঘাতে মারা যান। অঙ্গহানি হয়ে বেঁচে থাকেন অসংখ্য; যাদের পক্ষে হয়তো জীবনে আর কারখানায় কাজ করা সম্ভব হবে না।
শুধু রানা প্লাজাই তো নয়, স্মার্ট, তাজরীনের মতো ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে; যা এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের দায়িত্বহীনতাকেই মূলত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। চার হাজারের বেশি পোশাক কারখানায় কাজ করছে ৩৬ লাখের বেশি শ্রমিক, যাদের শ্রমে দেশ পাচ্ছে ভালো অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা; তাদের জীবনই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। শিল্পমালিকরা উৎপাদন উপকরণের বিমা করান খুবই গুরুত্বের সঙ্গে, কিন্তু এগুলো সচল রাখেন যারা তাদের জীবনবিমা করার তাগিদ অনুভব করেন না। অথচ এ বিষয়ে আইন আছে। আইনে স্পষ্ট উল্লেখও আছে যে, কোনো কারখানায় দুশ’র বেশি শ্রমিক থাকলে তাদের প্রত্যেককে গ্রুপবিমার আওতায় আনতে হবে। সম্প্রতি সংশোধিত এ আইনে এখন একশ’ শ্রমিক কর্মরত থাকলেই গ্রুপবিমা করার কথা বলা হয়েছে। চমৎকার সব আইন, আইনের যুগোপযোগী সংস্কার সবই আছে। কিন্তু শ্রমিক বা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ওপর আইনের সেসব ধারা কাজ করে খুবই কম। আইন ভেঙে সহজে পার পান ক্ষমতাবানরা। যে কোনো অপরাধের সাজা এড়ানোর ম্যাকানিজম তারা জানেন। কারণ সব সরকারের সময় তারা থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত যতই থাক, এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ নেই। স্বার্থের বেলায় প্রশ্নহীন আপোসে তারা অনায়াসে এক পঙ্ক্তিতে বসে একই সুরে কথা বলেন। তারা জানেন দুর্নীতির যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতি এ পর্যন্ত এসেছে তারা তার উত্তরাধিকার বহন করছেন। সুতরাং যত ভয়ংকর ঘটনাই ঘটুক তারা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। এই ‘আত্মবিশ্বাস’ এগারোশ’ পঁচিশজন মানুষকে বিকৃত লাশে পরিণত করে। গোঁজামিল দেওয়া স্থাপনা রানা প্লাজাকে ঝুরঝুরে বালিতে পরিণত করে। রানা প্লাজা বাংলাদেশের রাজনৈতিক হঠকারিতা ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নির্মম ও নৃশংস প্রতীক হয়ে আছে।
যে সাভারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক সময় সম্পন্ন মানুষের ঘর-গৃহস্থালি করে স্থায়ী হওয়ার আকাক্সক্ষা জাগিয়েছিল সেই শান্ত-স্নিগ্ধ সাভারের ঘাসে ঢাকা নরম মাটি রক্তাক্ত হয়েছে ক্ষমতাহীন শ্রমিকের রক্তে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথার রাক্ষসদের একফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লে তা থেকে শত শত রাক্ষস জন্ম নিয়ে হাউ মাউ খাউ করে তেড়ে আসত ‘বীর’ রাজপুত্রের দিকে। ওদের শক্তির কাছে রাজপুত্র এক ফুঁয়ে উড়ে যাওয়ার মতো অসহায়। শক্তিতে নয় ছলচাতুরী প্রয়োগ করে রাক্ষস মেরে বীরের মর্যাদা পেতেন রাজপুত্র।
রানা প্লাজায় আটকেপড়া শ্রমিকের রক্ত কি হাজার হাজার শ্রমিক হয়ে তেড়ে আসবে কোনোদিন? অতীতে যতবার আসতে চেয়েছে ততবারই ‘বীর রাজপুত্ররা’ ছলচাতুরীতে বশ করেছে তাদের। যেদিন সব বশ্যতা ভেঙে দলে দলে এসে নিজেদের পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেওয়ার কৌশল রপ্ত করতে পারবে সেদিন বন্ধ হবে পোশাক কারখানার রক্তের ধারা। দু’হাজার তের’র চব্বিশ এপ্রিল বাংলাদেশের পোশাক খাতে একটি গভীর ক্ষত, একটি হৃদয়বিদারক রক্তক্ষরণের স্মৃতি হয়ে আছে।
প্যানেল