
.
বাংলাদেশের কক্সবাজার-উখিয়া-টেকনাফ সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে নানারকম অপরাধমূলক কর্মকা- বেড়েই চলেছে। সামরিক জান্তাশাসিত মিয়ানমারে কিছুদিন থেকে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কর্মসূচি প্রায় স্থবির হয়ে পড়ায় অপরাধের মাত্রা আরও বেড়েছে ইতোমধ্যে। এসবের মধ্যে রয়েছে মানব পাচার, মাদক পাচার, নিজেদের মধ্যে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা, মারামারি-হানাহানি-গোলাগুলি সর্বোপরি অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশের এনআইডি ও পাসপোর্ট বাগিয়ে নিয়ে নানা দেশে চলে যাওয়া ইত্যাদি। সম্প্রতি বেড়েছে সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের বিদেশে বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে পাচারের অপচেষ্টা। এর ফলে ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে কিছু রোহিঙ্গার জীবনহানিও ঘটেছে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে। অনেকেই আবার আশ্রয়ের সন্ধানে পাড়ি দেওয়া দেশের উপকূলরক্ষীদের হাতে আটক হয়েছেন।
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর থেকে এমভি কুলসুমা নামের মাছ ধরার একটি ট্রলার জব্দও করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। নৌকাটিতে ছিল ২২১জন আরোহী। যাদের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। ধৃতদের মধ্যে ১৬৭ জন রোহিঙ্গা, ৪২জন বাংলাদেশী। আরও ছিল ১২ জন দালাল। তাদের গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া। সেখানে পৌঁছানোর পর দালালদের মাথাপিছু ৩ লাখ করে টাকা দেওয়ার কথা ছিল স্বজনদের। টাকা দিতে না পারলে পাচারকৃত ব্যক্তিদের অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কথাও ছিল। দালালদের মধ্যে ৬ জন রোহিঙ্গা এবং বাকিরা বাংলাদেশী। দালালদের এরকম অন্তত ১৫টি মানব পাচারকারী চক্র রয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। গত দুই বছরে পুলিশ অন্তত ১৫৫ জন মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। এর বাইরেও রয়েছে মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধী চক্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ইতোমধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইলেও মুষ্টিমেয় কিছু রোহিঙ্গা বাধা দিচ্ছে প্রত্যাবাসনে। এর পরিবর্তে তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম, সহিংসতা, হানাহানি, সশস্ত্র সংঘাত ছড়িয়ে দিতে চাইছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারভিত্তিক দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষে কয়েকজন রোহিঙ্গার নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। দুই গ্রুপের একটি হলো আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং অন্যটি আরাকান সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও), যাদের সশস্ত্র সংঘাত দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পথের ফাঁক-ফোকর দিয়ে তারা প্রায়ই ঢুকে পড়ে সংগঠন দুটি হামলা চালায় রোহিঙ্গা শিবিরে। এতে শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্বভাবতই ছড়িয়ে পড়ে ভীতি ও আতঙ্ক, যা বাংলাদেশের জন্য সমূহ আশঙ্কা ও বিপদের।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ভাগ্যবিড়ম্বিত শরণার্থীরা বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান সমস্যা। টেকনাফ-কক্সবাজার উপকূলবর্তী বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মাদক ও মানব পাচার ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে বলেও প্রমাণিত। রোহিঙ্গা শিবিরগুলো প্রাচীরবেষ্টিত ও সুরক্ষিত নয় বলে সীমিত পুলিশি নজরদারির সুবাদে তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বত্র। শিশু চুরি, ইয়াবা পাচার, হত্যা-খুনসহ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশী স্মার্ট কার্ড, পাসপোর্ট বাগিয়ে নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। সেখানেও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। এভাবে চলতে থাকলে রোহিঙ্গা বিশেষ করে তরুণদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আরও জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে।
প্যানেল