
সাবরিনা শুভ্রা
নতুন সূর্য উঠেছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আকাশে। তবে এ কেবল একটি বর্ষপঞ্জির পাতা উল্টানোর মুহূর্ত নয়, এটি যেন এক নতুন যুগের আলোর পূর্বাভাস—যেখানে দীর্ঘদিনের অন্ধকার শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ আবার ফিরে আসতে চায় তার গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপে।
গত এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে আমরা এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অন্ধকারে বাস করেছি। যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল ছিন্নভিন্ন, যেখানে ভোট ছিল বন্দী, সংবাদমাধ্যম ছিল রক্তাক্ত, বিরোধী রাজনীতি ছিল রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার। এ দেশের জনগণ দেখেছে কীভাবে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিণত হয় একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসনে—যেখানে দেশের নাম লেখা হয়, কিন্তু দেশের মানুষ থাকে অনুপস্থিত।
এই দীর্ঘ অন্ধকার যাত্রার পর আজ যখন আমরা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে যাচ্ছি, তখন চারপাশে একটি পালাবদলের সাড়া। এই নববর্ষ ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম নববর্ষ—অন্তত আশাবাদের জায়গা থেকে এ কথা বলাই যায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা একটাই—সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
এবারের নববর্ষ উৎসবে কিছু প্রতীকী পরিবর্তন আমাদের নতুন বাস্তবতার কথাই বলছে। দীর্ঘদিন ধরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামক সাংস্কৃতিক আড়ালে যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলছিল, এবার সেই আয়োজনের নামকরণই বদলে গেছে—এবার তা ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। আনন্দের অধিকার যে কেবল একশ্রেণির নয়, সেটা প্রকাশ করার এ যেন এক প্রতীকী প্রতিবাদ।
আলোচিত একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। শোভাযাত্রার মোটিফ হিসেবে তৈরি হয়েছিল সাবেক স্বৈরশাসকের মুখমণ্ডল, যেটি রাতের আঁধারে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কারা করেছে, কীভাবে করেছে—সে উত্তর আজও অজানা। তবে কাজটি যেন সময় নিজেই করেছে। প্রতীক ভেঙে পড়ে, যখন ক্ষমতা হারায় তার নৈতিক ভিত্তি। ইতিহাসে একে বলে প্রতীকী মুখাগ্নি।
এই নববর্ষে, জনগণের শুভেচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে একটি প্রার্থনা—বাংলাদেশ ফিরে পাক তার হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির প্রাণশক্তি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতি দেশের মধ্যে ও বাইরের বিশ্বে আস্থা সৃষ্টি করেছে। একসময়ের ‘দুর্নীতির হুজুগে’ যাকে দমন করা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসায়, আজ সেই মানুষটি গণতন্ত্রপন্থী শক্তির পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছেন।
নববর্ষের এই মুহূর্তে তাই আমাদের প্রত্যাশা ও দায়—আমরা যেন কেবল ফ্যাসিবাদকে বিদায় জানিয়ে ক্ষান্ত না হই, আমরা যেন সত্যিকারের গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাই। একটা রাষ্ট্র নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, পাশাপাশি আইনের শাসন, মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, মুক্ত সংস্কৃতি এবং গণ-অংশগ্রহণের মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে ভাবা। আমরা কী চাই? কেমন বাংলাদেশ আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চাই? যে বাংলাদেশে ভিন্নমত মানে শত্রুতা নয়, বিরোধী দল মানে রাষ্ট্রদ্রোহী নয়, সংবাদ মানে রাষ্ট্রদূতের ডেকে পাঠানো নয়—সে বাংলাদেশই কি আমাদের নতুন বছরের অঙ্গীকার হবে না?
১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রহরে আমরা তাই একটি আহ্বান জানাই—সকল রাজনৈতিক শক্তি, নাগরিক সমাজ ও সংস্কৃতিবান মানুষদের প্রতি—আসুন, এই নববর্ষে আমরা কেবল উৎসব নয়, গড়ি একটি নতুন জাতীয় চুক্তি। যেখানে কেন্দ্র হবে মানুষ, সার্বভৌম হবে জনগণ। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়াই হোক এবারের নতুন বর্ষের কামনা, প্রতিষ্ঠিতি হোক জনগণের সরকার, নির্বাচিত সরকার, গণমানুষের সরকার।
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা দেশবাসীকে।
জয় হোক স্বাধীনতার, জয় হোক মানুষের।
সাবরিনা শুভ্রা
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক।
রিফাত