ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

মুঘল আমলের সৌন্দর্যের নিদর্শন মথুরাপুর দেউল

নাফিজ-উর-রহমান

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

মুঘল আমলের সৌন্দর্যের নিদর্শন মথুরাপুর দেউল

‘মথুরাপুর দেউল’ ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার মথুরাপুর গ্রামে অবস্থিত একটি দেউল বা মঠ। এই প্রত্নতত্ত্ব অবকাঠামোটি আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি করা হয় বলে অনেকের ধারণা। তবে কারও কারও অনুমান এটি সপ্তদশ শতকের স্থাপনা। এই দেউলটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মধুখালী বাজার থেকে মধুখালী-রাজবাড়ী ফিডার সড়কের দেড় কিলোমিটার উত্তরে এবং মধুখালী-বালিয়াকান্দি আঞ্চলিক সড়কে মধুখালী সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, যার বিপরীত দিক (সড়কের পশ্চিম দিক) দিয়ে বয়ে গেছে চন্দনা নদী। কথিত আছে সংগ্রাম সিং নামক বাংলার এক সেনাপতি এটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৬৩৬ সালে ভূষণার বিখ্যাত জমিদার সত্রাজিতের মৃত্যুর পর সংগ্রাম সিংকে এলাকার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তৎকালীন শাসকের ছত্রছায়ায় তিনি বেশ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। এলাকার রীতি অনুসারে তিনি কাপাস্তি গ্রামের এক বৈদ্য পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন এবং মথুরাপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। অন্য এক সূত্রমতে, সম্রাট আকবরের বিখ্যাত সেনাপতি মানসিং রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে এই দেউল নির্মাণ করেছিলেন। সে অনুযায়ী, মথুরাপুর দেউল একটি বিজয়স্তম্ভ। তবে সূত্রটির সত্যতা নিরূপণ সম্ভব হয়নি।
এই দেউলটি বারোকোণ বিশিষ্ট, যার ভিতর একটি ছোট কক্ষ রয়েছে। এর গঠন প্রকৃতি অনুসারে একে মন্দির বললে ভুল হবে না। এটি একটি রেখা প্রকৃতির দেউল। ষোড়শ শতাব্দীর স্থাপনাগুলোর মধ্যে মথুরাপুর দেউল সম্ভবত একমাত্র রেখা প্রকৃতির দেউল। দেউলটিতে দুটি প্রবেশ পথ আছে, একটি দক্ষিণমুখী অন্যটি পশ্চিমমুখী।
দেউলটি কারুকাজ খচিত প্রায় ৯০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। এই দেউলটির গায়ে রয়েছে টেরাকোটার  দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক কারুকার্য। দেউলটির শরীর জুড়ে রয়েছে শিলা খন্ডের ছাপচিত্র। রয়েছে মাটির ফলকের তৈরী অসংখ্য ছোট ছোট মুর্তি; যা দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষনীয়। দেউলটির গায়ে সেঁটে দেওয়া ছোট ছোট মুর্তির মধ্যে রয়েছে  নর-নারী, নৃত্যরত নর-নারী, তীর ধনুক হাতে হনুমান, পেঁচা, জাতীয় পাখি, মস্তকবিহীন মানুষের প্রতিকৃতি, দ্রুতগামী ঘোড়া ইত্যাদি।
বারোটি কোণ থাকায় ওপর থেকে দেখলে এটিকে তারার মতো দেখা যায়। স্থাপনাটির মূল গঠন উপাদান চুন-সুরকির মিশ্রণ। দেউলের বাইরের দেয়ালটি লম্বালম্বিভাবে সজ্জিত, যা আলোছায়ার সংমিশ্রণে এক দৃষ্টিনন্দন অনুভূতির সৃষ্টি করে। পুরো স্থাপনা জুড়ে টেরাকোটার জ্যামিতিক ও বাহারী চিত্রাংকন রয়েছে। রামায়ণ কৃষ্ণলীলার মতো হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর চিত্র, গায়ক, নৃত্যকলা, পবন পুত্র বীর এবং যুদ্ধচিত্রও এই দেউলের গায়ে খচিত রয়েছে। প্রতিটি কোণের মাঝখানে কৃত্তিমূখা স্থাপন করা রয়েছে। তবে দেউলটির কোথাও কোনো লেখা পাওয়া যায়নি। বাংলার ইতিহাসে এর নির্মাণশৈলী অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি সুরক্ষিত সম্পদ।

 লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

×