ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

সাম্য ও বৈচিত্র্য উদযাপনের সংস্কৃতিÑ পহেলা বৈশাখ

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: ১৯:৩২, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

সাম্য ও বৈচিত্র্য উদযাপনের সংস্কৃতিÑ পহেলা বৈশাখ

পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়াই মানুষের সহজাত প্রবণতা। এই প্রবণতা বাঙালির মধ্যেও রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ পুরনো ও সমৃদ্ধ। আর বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। সমৃদ্ধ এই সংস্কৃতির সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসব নিবিড়ভাবে জড়িত। বাংলা নববর্ষ যেমন সুর ও সংগীতের, মেলা ও মিলনের, আনন্দ অবগাহনের, তেমনি সাহস ও সংকল্পের। নতুন প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যাশায় বুক বেঁধে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় বাংলা নববর্ষ। বৈশাখের স্পর্শে যেন আনন্দের কোলাহল জেগে ওঠে দেশের সর্বত্র। এক প্রাণচাঞ্চল্যে দুর্দমনীয় গতির ঘোড়ায় আসে বৈশাখ। এসেই সর্বদিকে তোলপাড় শুরু করে। ফলে বৃক্ষ থেকে বাতাস পর্যন্ত অন্যরকম দোলায় দুলতে থাকে। প্রকৃতি যেন ব্যস্ততায় মেতে ওঠে। স্বাগত জানায় বৈশাখি নব আনন্দের দিনকে। মানুষ পরিবর্তন ভালোবাসে খুব। এক জায়গায় কিংবা এক রকমের গতি মানুষের সব সময় ভাল লাগে না। নিত্যদিন মানুষ নতুনের সন্ধান করে। মানুষের এ চাওয়াও চিরকালীন। প্রতিটি দিনকে মানুষ আলাদা করে দেখতে ভালোবাসে। আলাদা আয়োজনে উদযাপন করতে চায় জীবনের প্রতিটি সকাল। যেভাবেই হোক মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন আলাদা, প্রতিটি সকাল আলাদা, প্রতিটি দুপুর কিংবা সন্ধ্যা অথবা রাত আলাদা। গতকালের সমস্ত বৈশিষ্ট্য গতকালেই থেকে যায়। চলে যায় অতীত নামক মহা সমুদ্রের দিকে। আজ যা ঘটে তা আগামীকাল কিছুতেই ঘটে না। এভাবে মানুষের জীবনে বদলে যায় সব। নতুন হয়ে আসে সব কিছু। বৈশাখ সৈই নতুনকেই আহ্বান জানায়। সৈই নতুনত্বকেই নিয়ে হাজির হয়। আমাদের জাতীয় কবির উচ্চারণে তারই দুর্দান্ত প্রতিধ্বনি শুনিÑ
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
এই যে নূতনের কেতন ওড়েÑ এটাই আনন্দের। এটাই উৎসাহের। এটাই সাহসের। সাহসই মানুষকে নতুন পথে তুলে দিতে সাহায্য করে। নতুনের জয়গানে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ গায়। নতুন করেই গায়। হোক পুরোনো গান কিন্তু কণ্ঠে বাজে নতুন করেই। নতুনের এই চির চেতনার ধ্বনিই যেন বৈশাখে প্রকাশিত হয়। পহেলা বৈশাখ পরমতসহিষ্ণুতা, সদ্ভাব, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং বিবেক ও মনুষ্যত্বের দীক্ষা দিয়ে যায় আমাদের। তাই তো আমরা বলে উঠি- ‘প্রাণে প্রাণে লাগুক শুভ কল্যাণের দোলা, নব আনন্দ বাজুক প্রাণে’। আজ ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। বৈশাখের প্রথম সকালে রাজধানীর রাজপথে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে মঙ্গল উচ্চারিত হতো- ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। বৈশাখের আছে বাইরের এক সাজ, সে সঙ্গে আছে অন্তর্জগৎ। বাইরের সাজ আমাদের নজর কাড়ে প্রবলভাবে, সেটা নিয়ে বাদ-বিসম্বাদও কম নেই। কিন্তু ভেতরের তাৎপর্য থাকে অনেকটা আড়ালে। ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ প্রভাতে রমনার পাকুড় ছায়াতলে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ বাঙালির চিরায়ত গান, কবিতায় বর্ষবরণ ছিল অভিনব আয়োজন, যা আলোড়িত করে জাতির চিত্ত। পহেলা বৈশাখের ভিন্নতর জাগরণী শক্তি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পৌঁছে দিয়েছিল একাত্তরের মহান সংগ্রামের দুয়ারে যা আমাদের এনে দিয়েছিল মহান স্বাধীনতা ।
পূর্ব বাংলার বাঙালি তার শিকড় অনুসন্ধান করে নতুনভাবে সাজায় বাংলা নববর্ষের উৎসবকে। সুদীর্ঘ ৫৬ বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এ নববর্ষ উদযাপন এখন সারাদেশ ও বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লাখ লাখ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নতুন জামাকাপড় পরে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধারণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন। এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা ‘ছায়ানট’ (১৯৬১)-এর। ছায়ানট সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি রমনার বটমূলে ১৯৬৭ সাল থেকে চালু করে নববর্ষের এই উৎসব। এই উৎসব বাঙালির জাতিসত্তার সঙ্গে যুক্ত বলেই অতি দ্রুত তা জনপ্রিয় হয় এবং প্রতিবছরই বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের উৎসব হয়ে ওঠে। নানা ডিজাইনের রং-বেরঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা-শাড়িতে সজ্জিত বাঙালি পুরুষ-নারীর বিপুল সমাগমে এই উৎসব এখন বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। এই উৎসব একসময় গ্রাম থেকে গ্রামে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে আর খুব বড়ো আকার গ্রহণ করেনি। এখন এই উৎসব গ্রাম থেকে বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত হয়ে রাজধানী ছাড়িয়ে বিভাগ, বিভাগ ছাড়িয়ে জেলা, জেলা ছাড়িয়ে উপজেলা এবং গ্রাম পর্যন্ত নব আঙ্গিকে এবং নব সাজে চালু হয়ে গেছে। এই উৎসব বাঙালি জীবনে যে আনন্দ বয়ে আনে, তার তুলনা বিরল। জীবন তৈরি হয় স্থান, কাল ও পাত্রের চালচিত্রে। আর জীবন এক জায়গায় থেমে থাকে না। সমাজের মানুষ জ্ঞাতসারে কী অজ্ঞাতে পাল্টাতে-পাল্টাতেই এগিয়ে যায়। কালের স্্েরাতে মানুষের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হয়, সামাজিক আচরণ ও অভ্যাসে ভিন্নতা আসে, শিল্পের সাধনায় বৈচিত্র্য দেখা দেয়, মোড়বদল ঘটে। খাদ্যের অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাস্ত নির্মাণ, ভাষা, ধর্ম, সামাজিক সংস্কার, এমনকি কুসংস্কার এবং মনের গড়ন ও কল্পনার ধাঁচ সবই একটি জাতির সাংস্কৃতিক উপাদান।
কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ার কারণে উৎসব-পালাপার্বণের সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। জীবনকে বাদ দিয়ে তাই সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে অনেকে পহেলা বৈশাখে নববর্ষের উন্মাদনায় বাউল বা বৈরাগীর বেশ ধারণ করে। কিন্তু যাদের কারণে, যাদের শ্রমে, যাদের মেহনতে, যাদের ঘামে, যারা রোদে-পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঝড়ের সঙ্গে মাঠে লড়ে, ঝড়ঝাপটা, বন্যা-খরা-দুর্যোগ সামাল দিয়ে মাঠে ফসল ফলান সেসব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের খবর আমরা কজনে জানি বা রাখি। যারা দেশ জাতি ও সমাজের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দেন, তারা আমাদের কৃষক জনগোষ্ঠী। বাংলা নববর্ষের এই লগ্নে একবারও কি ভাবা যায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরা কেমন আছেন? উৎপাদন ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? তবে এটা ঠিক বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতির কিংবা বাংলা ঋতুর কথা ভুলেই যেত। দেশ ও জাতির মঙ্গলে জনগণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, খুলে যাক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলা নববর্ষে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ,
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা

×