ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখীমেলা

সালমা আহমেদ

প্রকাশিত: ১৯:২৮, ১৩ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৯:২৯, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখীমেলা

বৈশাখ মানেই পান্তা-ইলিশ, হরেক রকম ভর্তা, মিষ্টি আর হালখাতার আয়োজন। বাংলার পথে-প্রান্তরে লাল-সাদা আর ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে হেঁটে বেড়ানো অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু। এখানে সেখানে বসে মেলা। আর মেলা মানেই বাঙালির লোক ঐতিহ্যের হরেক রকম জিনিসের সমাহার। মুড়ি-মুড়কি, মিষ্টি, ঘরের নানা তৈজসপত্র, কাঁচের চুড়ি আর নাগরদোলার ক্যাচর ক্যাচর শব্দে মেতে ওঠে সবাই বৈশাখীমেলায়। প্রখর রোদ উপেক্ষা করে সবাই অংশ নেয় বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখে। তার সঙ্গে প্রাণ সঞ্চার করে  বৈশাখীমেলা। ছেলেবেলায় বৈশাখ এলেই এলাকার ছেলেরা বড় সাউন্ড সিস্টেমে ফিডব্যাকের মাকসুদের গান বাজাতÑ ‘এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি, মেলায় যাই রে’ ...। গানের সঙ্গে মন মেতে উঠত।
চৈত্র সংক্রান্তিÑ চৈত্রসংক্রান্তি মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান। দিনটি পালন করা হয় মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক রচনার যে চর্চা এই নদীমাতৃক সবুজ ভূমিতে দীর্ঘকালব্যাপী জড়িয়ে আছে, তাকে চেনা ও জানার জন্য। এক সময় চৈত্র সংক্রান্তিতে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই বিভিন্ন আচার পালন করতেন। কালক্রমে তা বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে দুপুরবেলার খাবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘চৌদ্দ’ রকমের শাক খাওয়া। এর মধ্যে অন্তত একটি তিতা হতে হবে। যেমনÑ গিমা শাক। চৈত্র মাসে গিমা শাক পাওয়া না গেলে মনে করা হতো প্রকৃতি থেকে জরুরি কিছু হারিয়ে গেছে। ছোটবেলায় অবশ্য পাড়ার বান্ধবীরা মিলে পুরো এলাকা ঘুরে আমিও ১৪ রকমের শাক সংগ্রহ করতাম। তিতা হিসেবে থাকত করলা। দুপুরে মা তা রান্না করে পরদিন বৈশাখের দুপুর পর্যন্ত খেতে দিতেন। এতে নাকি সারা বছর এলার্জি জাতীয় রোগ বালাই দূর হয়।
চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামে মেলা বসত। সেই মেলা চলত বৈশাখের পুরো মাসজুড়ে। মানুষ বলত ‘পরব’। কত কিছু পাওয়া যেত সেই পরবে। মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, নানা রকম ছোট-বড় ফল, প্লাস্টিকের খেলনা, নানা রকম মিষ্টি, পিঠাসহ আরও কত রকম খাবার। থাকত তামা, কাঁসা, পিতলের তৈরি নানা জিনিস। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে চলত নাগরদোলা। ঢাকায় বসবাসের কারণে গ্রাম্যমেলা দেখার সুযোগ মেলেনি। তবে খালা যখনই ঢাকায় আসতেন, মাটির হাঁড়ি, পুতুল, মাটির তৈরি নানা রকম ফল নিয়ে আসতেন। পাটের তৈরি সুন্দর নকশার ছিকাও এনেছিলেন একবার।
বৈসাবিÑ বৈসাবি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। উৎসবটি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু, ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব বা বাইসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই নামে পরিচিত। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাÑ এই তিন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান উৎসবকে একত্রে উদ্যাপন করার একটি প্রথা এই বৈসাবি। চৈত্র মাসের শেষ দুদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথমদিনÑ এই তিনদিন অনুষ্ঠান পালন করে তিন সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের বিশ^াসÑ প্রকৃতিই জীবনের উৎস, যাপনের বাহন। তাই তাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে থাকে প্রকৃতির ছোঁয়া। এজন্য বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যবহার চোখে পড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে। প্রকৃতি পূজার বিভিন্ন প্রথাও দেখা যায়। প্রথম দিনগুলো মূলত ফুল সংগ্রহ, বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ইত্যাদিতে কাটানো হয়। দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয় খাওয়াদাওয়া, অতিথি আপ্যায়নের মূল পর্ব। নতুন বছরের খাদ্য-পানীয়ের মহোৎসব, সে পাহাড়ে হোক কিংবা সমতলে। খাবারের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন থাকে, তেমনি থাকে নতুন নতুন খাবারও। বিভিন্ন ধরনের পিঠাও খাওয়া হয় এ সময়। বিন্নি চালের বড়া পিঠা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
হালখাতাÑ বৈশাখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘হালখাতা’। মূলত হালখাতাকে কেন্দ্র করেই বৈশাখ পালন শুরু হয়। ব্যবসায়ীরা এদিনে পুরনো বছরের হিসাব করেন। বড় বড় ক্রেতা যারা আছেন তাদের দাওয়াত করে মিষ্টিমুখ করান। পুরানো পাওনা আদায় ও নতুন ব্যবসার বায়না করেন। মিষ্টি খাওয়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত ক্রেতাদের নানা রকম উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকেন। লাল রঙের খেরো খাতায় লেখা থাকে ব্যবসায়ীদের সারা বছরের লাভ-লোকসান আর দেনা-পাওনার হিসাব।
বৈশাখীমেলাÑ সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় চৈত্রের শেষদিন থেকে শুরু হয় মেলা। ঢাকার মেলা খুব ছিমছাম, গোছানো। মা-খালার কাছে শোনা গ্রামের পরবের একটা ছবি মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলাম সেই কৈশোরেই। অনেক কিছুই শহুরে মেলায় পাওয়া যায়, কিন্তু সেই উল্লাস, জৌলুস থাকে না। ৫/৬ বছর আগে একবার বৈশাখ সামনে রেখে গ্রামে গিয়েছিলাম এই পরব দেখব বলে। খালা বললেন, এখন আর তেমন করে পরব হয় না, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তবু ফেরার পথে পহেলা বৈশাখে ভাগিনা নরসিংদী সদরে অনুষ্ঠিত হওয়া এলাকার এক ছোট মেলা দেখাতে নিয়ে যায়। ঐ প্রথম গ্রাম্যমেলা দেখা। ছোট হলেও মন ভরে গিয়েছিল সেই মেলায়। পথের পাশেই ত্রিপল টানিয়ে গাছের নিচে, ব্রিজের পাশে সারি সারি দোকান। একটানা কয়েকটি দোকানে শুধু মাটির খেলনা আর ঘরের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। আম-কাঁঠাল-তালের নকশায় তৈরি মাটির ব্যাংক কি জীবন্ত! ঢাকা থেকেই কেনা প্রায় ২০/২৫ বছর আগের পেঁপে আর কাঁঠালের ব্যাংক আছে আমারও। পাশাপাশি আরও কিছু দোকানে সারি সারি সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল, পাশেই তামা-কাঁসা, দা-বটিসহ ঘরের ব্যবহার্য তৈজসপত্র। একপাশে তৈরি হচ্ছে নানা রকম মুখরোচক ভাজাপোড়া খাবার। আরেক পাশে নানা রকম মিষ্টি, নিমকি, মুড়ালি। গাছের নিচে, ব্রিজের পাশে বসেছে আরও কত রকম মনোহরি জিনিসপত্র! গ্রামের তাজা ফল ও সবজিও রয়েছে। আর চুড়ি, মালা, কানের দুলসহ নানা রকম জুয়েলারি সামগ্রী তো রয়েছেই। বায়োস্কোপ চলছে। ছোট-বড় সবাই দেখার জন্যে উদগ্রীবÑ এই যে দেখ আইসা গেল। কি যে এক ভালো লাগা বিরাজ করছিল মনের কোণে।
জায়গাভেদে ঢাকায় এখন বৈশাখীমেলা সপ্তাহ, পাক্ষিক ও মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। তবে বেশিরভাগ মেলাই বসে কোনো প্রতিষ্ঠান বা বহুতল ভবনের কোনো খোলা জায়গায়। যা কোনো না কোনো সংগঠনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এসব মেলায় জামা, শাড়ি, কসমেটিকস, বাঁশ ও পিতলের তৈরি কিছু শোপিসও পাওয়া যায়। বড্ড বেশি কৃত্রিম লাগে। বৈশাখীমেলা মূলত লোকজ সংস্কৃতির ধারক। এ মেলা বাঙালির কাছে এক অনাবিল আনন্দের আমেজ হিসেবে ধরা দেয়। গ্রামে এক সময় এসব মেলায় সার্কাস, মোরগ লড়াই। মেলার পরিধি বড় হলে অ্যাক্রোবেটিকও চলত।
নববর্ষ উদযাপনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বৈশাখীমেলার আয়োজনগুলো সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মানিক মিয়া এভিনিউ, বনানী, গুলশান, মিরপুর, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী। এ ছাড়া ঢাকায় চারুকলায় নিজস্ব উদ্যোগে তাদের তৈরি হাতের কাজগুলোর বিক্রয় ও প্রদর্শনীস্বরূপ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রমনা, শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলা একাডেমিতেও অনুষ্ঠিত হয় মেলা। সেখানে কখনো পুতুল নাচের ব্যবস্থাও থাকে। মেলায় বড়রা, বিশেষ করে যাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে, তারা আসেন অতীতটাকে ছুঁয়ে দেখতে আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লোকায়ত বাংলার ঐতিহ্যকে পরিচয় করিয়ে দিতে। শহরেও এক সময় গ্রামীণ ঐতিহ্যকে খুঁজে পাওয়া যেত এসব মেলায়। তবে দিন বদলেছে। সময় ও জায়গার অভাবে ঐতিহ্য হারাচ্ছে। গত ৩-৪ বছর যাবত করোনা, ডেঙ্গু, রোজা, ঈদ ইত্যাদি কারণে বৈশাখী আয়োজনের পরিসর কম ছিল। এবার হয়তো অনেক বড় পরিসরে বৈশাখীমেলা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আশা করা যায় সবাই এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের নানা উৎসব এবং মেলায়।
লেখক : সাংবাদিক

×