ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

নববর্ষের আহ্বান

সুকান্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ১৯:২০, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

নববর্ষের আহ্বান

বাংলা নববর্ষ বাঙালির আদি উৎসব। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘খ্রিস্টাব্দ, হিজরি অব্দ, শতাব্দ, বিক্রমাব্দ, বুদ্ধাব্দ, বঙ্গাব্দ প্রভৃতি কোনো নির্দিষ্ট বছরের সঙ্গে নববর্ষের কোনো যোগ নেই। অর্থাৎ, কোনো ধরনের বছরের গণনার প্রারম্ভ থেকে কোনো দেশের অথবা জাতির নববর্ষ শুরু হয়নি। এ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসা একটা বার্ষিক উৎসব। আধুনিক নববর্ষের উৎসবের মধ্যে লুকিয়ে আছে আদিম নববর্ষের পরিবর্তিত রূপ। আবহমান বাংলার এই প্রাচীন রূপ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, কৃষিভিত্তিক সমাজের জীবনব্যবস্থায় ফসলকেন্দ্রিক উৎসব বড় আকারের সামাজিক উৎসবের সূচনা করে।
বাংলা নববর্ষের উৎসব আছে বলেই বাঙালির পরাজয় নেই। জাগরণের জয়ধ্বনি বাজায় এই উৎসব। মানুষ জড়ো হয় আপন নিয়মে। এই উৎসব শহরের ইট-কাঠ থেকে গ্রামের মেঠোপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য অর্থে বলা যায়, এই উৎসব বয়ে এনেছে শস্যদানা। জলবতী মেঘ। রুপালি ইলিশ। বিনয় বাঁশির ঢোল। এখন এর সবটুকু শহরে প্রতিটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন। নন্দিত হয় পুরো দেশ।জীর্ণ-পুরোনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে বাঙালি জাতি। এদিনের জন্য আমরা প্রতীক্ষা করে থাকি। এই অপেক্ষা সাংস্কৃতিক চেতনাবোধের জায়গায় নিজেদের পরিশীলিত করার প্রতীক্ষা। নতুন প্রজন্মকে তার শেকড়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা। দেশজুড়ে এই উৎসবের আয়োজন হয় বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায়। বাঙালির পথচলায় নববর্ষ হলো বাতিঘর। বিভ্রান্তির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই বাঙালির। অমোঘ শক্তির দীপ্তি তার মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘এই মহামান্বিত জগতের অদ্যকার নববর্ষ দিন আমাদের জীবনের মধ্যে যে গৌরব বহন করিয়া আনিল, এই পৃথিবীতে বাস করিবার গৌরব, আলোকে বিচরণ করিবার গৌরব, এই আকাশতলে আসীন হইবার গৌরব, তাহা যদি পরিপূর্ণভাবে চিত্তের মধ্যে গ্রহণ করি, তবে আর বিষাদ নাই, নৈরাশ্য নাই, ভয় নাই, মৃত্যু নাই।’ বাঙালি নববর্ষের এই গৌরবের জায়গাটি তৈরি করেছে। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দান করে রক্ষা করেছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা ভাষার স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করে উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দিয়েছে। তারপরও বলতে হবে দুটি গভীর ও ব্যাপক অর্জন বাঙালির সামনে পাহাড় সমান উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা বাঙালির আত্মশক্তির উৎসব। মনুষ্যত্বের জাগরণের উৎসব।
নববর্ষের আয়োজনের সাথে জড়িয়ে আছে হালখাতা। যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। যা মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। পুরোনো দিনে বাংলা বছর বরণের জন্য পহেলা বৈশাখ পালনের পাশাপাশি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকত আরও একটি অনুষ্ঠান, আর তা হলোÑ হালখাতা বা গদ্দিশাইট। এটি যুগের পর যুগ ধরে বাপ-দাদার লৌকিক সংস্কার, যা পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান। চারশত ত্রিশ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য এ হালখাতা। ব্যবসায়ীরা তাদের সারা বছরের লেনদেন, বকেয়া, হিসাব নিকাশ লিখে রাখতেন তাদের লম্বা মোটা লাল সালু কাপড়ের মলাটের খাতায়।
হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। হালখাতার ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃতি ও ফারসি উভয় ভাষার সমন্বয়, হাল শব্দের অর্থ ‘লাঙল’। তখন মুদ্রার প্রচলন ছিল না বিধায় কৃষকের উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময়ের হিসাব যে খাতায় লিখে রাখতেন, তার নামই হালখাতা। ব্যবসা-বাণিজ্যে কৃষিপণ্য বিনিময় করে রশিতে গেরো দিয়ে হিসাব রাখা হতো। তখন কেউ কেউ ঘরে মাচার খুঁটিতে দাগ দিয়ে হিসাব রাখতেন। পরে কাগুজে টাকার প্রচলন হলে তার লেনদেন, বাকির হিসাব লিপিবদ্ধ করার জন্যই প্রচলন হয় হালখাতা। হালখাতার পাশাপাশি জমিদারদের খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা হতো ‘পুণ্যাহ’। নতুন বছরে প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাকে সজ্জিত হয়ে জমিদার বাড়িতে আসতেন। খাজনাদি পরিশোধ করার পর তারা আপ্যায়িত হতেন মিষ্টিতে। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে পুণ্যাহ। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ পুণ্যাহ প্রথা চালু করেছিলেন। গ্রামে লোকজন হালখাতাকেই পুণ্যাহ বলে। আসলে তা সঠিক নয়। কেননা, জমিদারি প্রথা উঠে গেছে অনেক আগেই। ফলে এখন আর পুণ্যাহ হয় না। যা হয়, তা হলো হালখাতা।
পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা। বৈশাখী মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা হয়, যা মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উন্মুক্ত মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। কৃষিক্ষেত্রেও বৈশাখ মাসের গুরুত্ব অনেক। বৃক্ষের ক্ষেত্রেও নবউদ্যমে নতুন জীবন শুরু হয় নতুন পাতা গজিয়ে। একটি খনার বচন বলা যায়। ‘মাঘে মুখী, ফালগুনে চুখি, চৈতে লতা, বৈশাখে পাতা’। উল্লেখ করা যায় আরও কয়েকটিÑ (১) ‘বৈশাখের প্রথম জলে, আশুধান দ্বিগুণ ফলে’, (২) ‘পৌষের কুয়া বৈশাখের ফল। য’দ্দিন কুয়া ত’দ্দিন জল। শনিতে সাত মঙ্গলে/(বুধ) তিন। আর সব দিন দিন’।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির আত্মচেতনার বড় দিগন্ত। এই দিন শুধু মাত্র উৎসব নয়। নববর্ষ আমাদের দিগন্তকে প্রসারিত করে। বাঙালি জাতির জন্ম ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার সভ্যতা, সংস্কৃতির, লোকাচার, উৎসব, পার্বণ সবই গড়ে উঠেছে কৃষিকে ভিত্তি করে। বাংলা সনের ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হয়নি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে শুরু, এরপর সম্রাট আকবর থেকে ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের খাজনা পরিশোধের রেওয়াজ শুরু পর এর বিকাশ। বিশাখা ও জৈষ্ঠা এই দুই নক্ষত্রের নাম থেকেই বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রকৃতির রুদ্ররূপ গ্রীষ্মের বৈশিষ্ট্য। কৃষি নির্ভর বাঙালির ক্ষণগণনা শেখাও প্রকৃতি থেকে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের সূচনা বিশ শতকে। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিলে, এর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে রমনায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। স্বাধীনতার পর এ আয়োজনই জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। সত্তর-আশির দশকে মূলত ছায়ানটেই সীমাবদ্ধ ছিল বৈশাখ উদযাপন। পরে যোগ হয় মেলা, সার্কাস থেকে শুরু করে নাচ-গানের আয়োজন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলার সময় ১৯৮৫তে যশোরে প্রথম শোভাযাত্রার আয়োজন করেন চিত্রশিল্পী এ এম সুলতান। এর পরের বছর থেকে শুরু চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। তা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। কালের পরিক্রমায় বাঙালির প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ। মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সকল অমঙ্গলকে পেছনে ফেলে বাংলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যে। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের লড়াইয়ে সাহস ও শক্তির এবং সত্য ও ন্যায়কে সমর্থন জানানোর নিদর্শন। বর্ণ, মত, ধর্ম, লিঙ্গ বা বয়স নির্বিশেষে জনগণকে একতাবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও এর প্রতি সহমর্মিতারও প্রতীক। এবার অবশ্য এর নতুন নামকরণ হয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা।
পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশের  আপামর নর-নারী ও শিশু এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতি কিংবা বাংলা ঋতুর কথা প্রায় বিস্মৃত হতো।  বাংলা নতুন নববর্ষে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। দেশ ও জাতির মঙ্গলে জনগণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। খুলে যাক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলা নববর্ষে এই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।

লেখক : আবৃত্তিশিল্পী এবং সংগঠক

×