ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

বাঙালির বিশ^সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ’

বাবুল চন্দ্র সূত্রধর

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

বাঙালির বিশ^সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ’

বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির উৎসব, সর্বজনীন উৎসব। শুধু বাংলায় বসবাসকারী নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নয়, এ উপলক্ষে ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি সব একাকার হয়ে যায়। অনেক বছর ধরেই বিশে^র বহু দেশের বহু শহরে/এলাকায় পুরোপুরি বাঙালি রীতিতে নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়। যেসব দেশে বাঙালি সংখ্যায় বেশি সেসব দেশে জাঁকজমকও অনেক বেশি হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, চীন, আইভরি কোস্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, সুইডেনসহ ইউরোপের নানা দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নববর্ষের সকল আনুষ্ঠানিকতা অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়। এসব দেশের বহু শহরে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়, যাতে বিচিত্র ধরনের পণ্যসামগ্রী ও খাবার-দাবারের উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি কাড়ে। বাহারি আল্পনা ও ফেস্টুনের মাধ্যমে সাজানো হয় অনুষ্ঠানস্থল। গান-বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এসব অনুষ্ঠানে কেউ কেউ বাঙালি সংগীতশিল্পীদের সমাবেশ ঘটিয়ে থাকেন। কোনো কোনো স্থানে দেশীয় খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। এক কথায় পয়লা বৈশাখ হচ্ছে বাঙালির একমাত্র উৎসব যেখানে সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে মিলিত হয় সবাই। সকলেই কণ্ঠ মিলান এই এক অভিন্ন গানে। বিশে^র অসংখ্য দেশে বাঙালি আজ উৎসবমুখর জাতি হিসেবে সকলের সমীহ অর্জনে সমর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাঙালির উৎসবে নেচে-গেয়ে আজ নেটিভরাও আনন্দ উপভোগ করছেন। অবশ্য বাংলা গানের যে শৈল্পিক গুণাবলী রয়েছে তা সংস্কৃতিমনস্ক যে কোনো ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। সংস্কৃতিপ্রিয় ও আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি স্বদেশে তো বটেই, বিশে^র যত জায়গায় বাঙালির বসবাস রয়েছে তত জায়গায়ই বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশও প্রকাশ বিদ্যমান। আর এসবের সর্বজন-পালিত আয়োজন হলো নববর্ষ।
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানটির রয়েছে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ পটভূমি। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে নববর্ষ উৎসবের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ১৯৬৫ সনে স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ কর্তৃক রমনার বটমূলে আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠানে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ মুখে মুখে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত গানটি স্বৈরাচারী ও সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে থেকে বাঙালিমাত্রেরই প্রাণের উৎসব এই নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের ঋষিবাক্যটিই যেন এখানে সত্যিকার রূপ নিলÑ ‘মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়, সে এখন শান্তির নববর্ষ নয়- পাখির গান তার গান নয়, অরুণের আলো তার আলো নয়। তার নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করে; আবরণের পর আবরণ ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে। প্রতিটি নববর্ষ সেই অভ্যুদয়ের আহ্বান নিয়ে আসে আমাদের কাছে। এই অভ্যুদয় হচ্ছে মনুষ্যত্ব লাভের দুঃসাধ্য সাধনা।’ বাঙালির জাতীয় জীবনে গান বা সংগীতের প্রভাব এখানেই স্তিমিত হয়ে পড়েনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীত এক জাদুকরী ভূমিকা পালন করেছিল বলে সুধীজন  মন্তব্য করে থাকেন। আমার সোনার বাংলা, ও আমার দেশের মাটি, কারার ঐ লৌহকপাট, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, জন্ম আমার ধন্য হল মাগো গান বাঙালির অগ্নিমননে ঘিয়ের যোগান দিয়েছিল। অপ্রস্তুত, নিরস্ত্র ও অপ্রশিক্ষিত বাঙালি দামাল বীরদের অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে এসব গান।
মানুষের জীবনের এক বিশেষ অনুষঙ্গ হলো সংগীত। শুধু আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, সংগীত মানুষের আত্মার সাথে জড়িত এমন এক সৃষ্টি যার ভেতরে মানুষ খুঁজে পায় তার ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠীজীবন, এমনকি জাতীয় জীবনের মূল উপাদানগুলো। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, সুখ ও দুঃখ, প্রশংসা ও খেদ, উচ্ছ্বাস ও যন্ত্রণাÑ সবকিছুই সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ ও অনুভব করা সম্ভব। সংগীত যেভাবে মানুষের মনকে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মাধ্যমে হয়তো তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্য বিশেষ বিশেষ সংগীত বিশেষ বিশেষ ঘটনা বা উৎসবের প্রতীক হয়ে উঠেছে। উৎসব বা অনুষ্ঠানে সংগীতের উপযোগিতা প্রসঙ্গে লোক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ আতোয়ার রহমান তাঁর ‘উৎসব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উৎসবের প্রেরণায় ধন্য সংগীতও যেমন যন্ত্রের তেমনি কণ্ঠের। উৎসবের প্রয়োজনে মানুষ আদিকাল থেকে চর্চা করেছে গীতের এবং আবিষ্কার করেছে নানাবিধ বাদ্যের যন্ত্র, যেগুলোর ভেতর আছে শঙ্খ এবং বাঁশের বাঁশি থেকে শুরু করে ঢাকঢোল অবধি। কণ্ঠ এবং যন্ত্রের সংগীত গোড়াতে অবশ্যই ছিল আজকের হিসেবে অমার্জিত, অপরিণত। কিন্তু জীবনের প্রয়োজন উৎসবের মাধ্যমে সেগুলোকে ক্রমশ করে তুলতে থাকে উন্নত। নৃত্যগীতবাদ্য ছাড়া আজও যে কোনো ধর্মীয় বা লৌকিক উৎসবই নিষ্প্রাণ। আধুনিককালে পশ্চিমের প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সংগীত উৎসবগুলোর ভূমিকা হয়েছে সর্বজননন্দিত। ব্রিটেনে, আমেরিকায় এবং ইউরোপের একাধিক দেশে  এ জাতীয় উৎসব এখন সাংস্কৃতিক বিকাশের এক প্রধান ধারা, সাংস্কৃতিক জীবনের বর্ণিল আভায় পরিণত।
নববর্ষ উৎসবটি মূলত পঞ্জিকাকেন্দ্রিক। বাংলা বারো মাসের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথমদিন নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়। অবশ্য বাংলা পঞ্জিকার উৎপত্তির রয়েছে এক দীর্ঘ  ঐতিহাসিক পটভূমি। সংক্ষেপে বলতে গেলে  মহারাজা বিক্রমাদিত্য (রাজত্বকাল ১০৫-১৫ খ্রিঃপূঃ) সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন, যার নাম ছিল ’বিক্রম সাম্বাত’। এটি ছিল মূলত  তিথি, নক্ষত্র, ঋতু প্রভৃতি সময় নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত একটি দিকনির্দেশনার সমাহার বিশেষ। রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল ৫৯০-৬২৬ খ্রিঃ) ৫৯৩ খ্রীস্টাব্দে একে দেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। অর্থাৎ এই সময় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে বাংলা পঞ্জিকা বা সনকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করার কৃতিত্ব মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫)। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় সকল কাজে হিজরি সন অনুসরণ করা হত। হিজরি সন হলো চন্দ্রভিত্তিক, আর ভারতীয় পঞ্জিকা হলো সৌরভিত্তিক। হিসাবের এহেন ব্যবধান থেকে শুরু হয় নানা ধরনের অসামঞ্জস্য। বিশেষত খাজনা আদায় ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। পঞ্জিকার একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সংস্করণ তৈরির জন্য আকবর দায়িত্ব দেন তার অন্যতম মন্ত্রী টোডরমল্ল ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে। এই দু’জন বিশেষজ্ঞের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানের ফলে বাংলা ও হিজরি সনের সমন্বয়ে খ্রিস্টীয় ১৫৮৪ইং সনে একটি নতুন পঞ্জিকার প্রবর্তিত হয়। সে থেকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পয়লা বৈশাখ সর্বমহলে গৃহীত ও পালিত হয়ে আসছে।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগীত বা গান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা শোনা যায়। আমাদের প্রিয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’কেও সমালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটির কোনো সমালোচনা অদ্যাবধি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অর্থাৎ, এ গানটি সকল বাঙালির অন্তরে এক সুদৃঢ় আসন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজনকেও গানটির কলি আওড়াতে শোনা যায়। এভাবেই বাঙালির অতি প্রিয় উৎসব পয়লা বৈশাখ বিশ্ববিজয়ে সফলতা অর্জন করেছে। বাংলার ঐতিহ্যের যাত্রা সারাবিশ্বে আরও সুসংহত হোক। জয় হোক বাংলা ও বাঙালির।

লেখক : মানবাধিকারকর্মী

×