ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১

নির্বাচনহীন দীর্ঘ সময় নয়, সংস্কার ও গণরায় হোক সমান্তরাল

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র

প্রকাশিত: ২১:০০, ১২ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:০১, ১২ এপ্রিল ২০২৫

নির্বাচনহীন দীর্ঘ সময় নয়, সংস্কার ও গণরায় হোক সমান্তরাল

রাষ্ট্রের কাঠামোগত সমস্যার সমাধান প্রয়োজন—এ কথা সন্দেহ নেই। আমরা এমন একটি প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা চাই, যেখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, প্রশাসন থাকবে নিরপেক্ষ, বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন, এবং রাজনীতির ভাষা হবে সহনশীল ও জনগণের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

কিন্তু এই সংস্কারের কাজকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিস্তার করা যাবে না। একটি গ্রহণযোগ্য সময়সীমার মধ্যে রোডম্যাপ নির্ধারণ করে সংস্কার ও নির্বাচন—দুটিকে সমান্তরালভাবে অগ্রসর করতে হবে। দীর্ঘ সময় নির্বাচনহীন যে শূন্যতা সৃষ্টি করে, সেটি কেবল ক্ষমতা দখলের খেলাকে আরও গভীর করে তোলে। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে—নির্বাচনহীনতা কখনোই স্থিতিশীলতা বা শান্তি আনতে পারে না; বরং এটি বিরক্তি, অনাস্থা ও বিকল্প শক্তির উত্থান ঘটায়।

প্রশ্ন ১: শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ছাড়া ও ভোট ছাড়া গণতন্ত্র কীভাবে নিশ্চিত হবে?
গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি হলো জনগণের মতামতের স্বাধীন ও স্বচ্ছ প্রতিফলন—অর্থাৎ, ভোটাধিকার। সুতরাং, ভোট ছাড়া গণতন্ত্র সম্ভব নয়। তবে কেবলমাত্র ভোট যথেষ্ট নয়, যদি না সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভোট অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু এই ভোট হতে হবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

তাই, প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত শাসনব্যবস্থার সংস্কার—যেখানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা, প্রশাসনের দলনিরপেক্ষতা, এবং রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশ্ন ২: কী ধরনের সংস্কার দরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য?
সংবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে যেসব পরিবর্তন অপরিহার্য, তা হলো—

১. নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা—যা হতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাইরে বিশেষ নিরপেক্ষ কমিটি।

২. নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সক্ষমতা—নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বাজেট ও নিরাপত্তা পর্যন্ত।

৩. দলনিরপেক্ষ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী—নির্বাচনকালে পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা।

৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা—নির্বাচনসংক্রান্ত যেকোনো মামলা ও অভিযোগ দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।

৫. প্রযুক্তি ও কারিগরি নিরপেক্ষতা—ইভিএম বা অন্য প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দলসমূহের সম্মতি নিশ্চিত করা।

প্রশ্ন ৩: এই সংস্কারগুলো করতে কত সময় লাগতে পারে?
যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা সর্বদলীয় বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই কাজ শুরু হয়, তাহলে—

সংলাপ ও কমিশন গঠন: ৩–৬ মাস

আইনি ও সাংবিধানিক সংশোধন: ৬–৯ মাস

কাঠামোগত রদবদল ও প্রস্তুতি (কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ): ৬ মাস

নির্বাচনের প্রস্তুতি ও পরিচালনা: ৩–৪ মাস

অর্থাৎ, সর্বোচ্চ ১৮ মাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব—যদি আন্তরিকতা ও জনগণের চাপ থাকে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—শাসনব্যবস্থা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন গ্রহণযোগ্য সরকারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, এবং সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সকল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সংলাপ ও ঐকমত্য প্রয়োজন। কিন্তু সেই আলোচনার মধ্যেও জনগণের ভোটাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনগণকে পাশে না রেখে, কিংবা তাঁদের মতামত নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে, শাসনের নতুন ছক আঁকা হলে তা গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রের পথ করে দেবে।

আমরা সবাই পরিবর্তন চাই। কিন্তু সেই পরিবর্তন যেন জনগণের অংশগ্রহণ ও অনুমোদনের মাধ্যমে হয়। আমরা আরেকটি ‘নির্বাচনহীন বছর’ দেখতে চাই না। আমরা চাই, শাসনব্যবস্থার সংস্কার ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের রোডম্যাপ একসাথে চলুক—জনগণের মতামতকে কেন্দ্রে রেখে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে জনগণের ভোটকে চূড়ান্ত নিয়ামক হিসেবে গণ্য করে।

নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই—এই সত্যটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। শাসনব্যবস্থার সংস্কার জরুরি, কিন্তু সেই সংস্কারের কথা বলে যদি দীর্ঘ সময় ধরে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে তা গণতন্ত্র রক্ষার পথ নয়; বরং গণতন্ত্র হরণের একটি ছলনা। শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবির সঙ্গে সঙ্গে অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সময়বদ্ধ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দীর্ঘ নির্বাচনহীনতার মধ্যে দেশ চালানোর বিপজ্জনক অভ্যাসকে আর প্রশ্রয় দিতে পারি না।

নুসরাত

×