
৬ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখ ছিল কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মদিন। রুপালি পর্দায় যিনি তার অনবদ্য অভিনয় দক্ষতা দিয়ে দর্শকদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। সুচিত্রা সেনের প্রকৃত নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। বেঁচে থাকলে এখন তিনি ছুঁতেন জীবনের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। যদিও ‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ অথবা হিন্দি ছবি ‘দেবদাস’ বা ‘আঁধি’তে দেখা সুচিত্রাকে কখনোই ছুঁতে পারেনি বার্ধক্য বা জরা। কোটি ভক্তের হৃদয়ে আজও সমুজ্জ্বল এ মহানায়িকা। বাংলা সিনেমাকে যিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ভিড়ের মাঝেও সুচিত্রা সেন ছিলেন একেবারেই স্বতন্ত্র।
শুরুতেই কিন্তু তার এ সফলতা আসেনি। অর্থাৎ, যাত্রাপথ মোটেই মসৃণ ছিল না। অনেক চড়াই-উৎরাই পাড় হতে হয়েছে। জীবনের প্রথম সিনেমাটি মুক্তিই পায়নি! ‘শেষ কোথায়’ নামের একটি ছবি দিয়ে সুচিত্রার অভিষেক হয়েছিল। কিন্তু কপাল এতই খারাপ যে, ছবিটি কোনোদিন আলোর মুখ দেখেনি। প্রথম ছবিতেই তিনি ধাক্কা খেলেন। ব্যর্থ হলেন কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। পরবর্তীতে উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে ৭৪’ ছবিটি পুরো বাঙালির মাথা খারাপ করে দিল। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
নায়িকা থেকে মহানায়িকা, রমা দাশগুপ্ত থেকে হয়ে ওঠেন সুচিত্রা সেন। তিনি ছিলেন একজন গুণী অভিনেত্রী। অভিনয় অনেকেই করেন, কিন্তু সুচিত্রা সেন সবাই হন না, হতে পারেন না। একজন মানুষ কিভাবে মূল্যায়িত হবেন, তা নির্ভর করে তার কাজের ওপর। যিনি যে কাজে নিয়োজিত বিশেষ করে সৃষ্টিশীল কাজ; সেখানে তিনি কতটা দক্ষতার ছাপ রাখছেন বা নিজস্বতা সৃষ্টি করছেন, তার ওপর নির্ভর করে তিনি কিভাবে ঠাঁই করে নেবেন মানুষের হৃদয়ে।
সুচিত্রার বাংলা সিনেমায় অভিষেক নাটকীয় হলেও হিন্দি সিনেমার অভিষেক ছিল সাফল্যে ভরা। বলিউডে প্রথম ছবি ‘দেবদাস’। এই ছবিতে পার্বতী চরিত্রে অবিস্মরণীয় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান সুচিত্রা সেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারজয়ী প্রথম বাঙালি অভিনেত্রী ছিলেন সুচিত্রা সেন। মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য এই স্বীকৃতি পান তিনি। ভারত সরকার ১৯৭২ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মাননা দেয়।
তবে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জীবন সর্বদাই মসৃণ ছিল না। তাঁর জীবনের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে প্রত্যাখ্যান শব্দটি। তিনি কিভাবে প্রত্যাখ্যাত হন, সে গল্পই বলব আজ।
প্রত্যাখ্যান শব্দটি একটি নেতিবাচক শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হলো উপেক্ষা, অগ্রাহ্য, বাতিল করা। সত্যি কথা বলতে কি প্রত্যাখ্যান শব্দটি শুনলে আমাদের মাথায় যে চিন্তাটি প্রথম আসে তাহলো, প্রেমের প্রত্যাখ্যান। কিন্তু প্রেমের প্রত্যাখ্যান ছাড়াও জীবনে চলার পথে বহু ক্ষেত্রেই আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় প্রত্যাখ্যানের। অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমারা প্রত্যাখ্যাত হই। প্রত্যাখ্যানের কষ্ট বড়ই বেদনাদায়ক। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ কোনো কাজে ‘না’ শব্দটি শুনলেই মস্তিষ্ক তা সহজভাবে গ্রহণ করে না। ফলে মনে কষ্ট হয়। আর মনের মধ্যে কষ্ট নিয়ে যত সময় যাবে তা মানসিক প্রশান্তিকে ছিনিয়ে নেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার বিখ্যাত ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্থে এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমার চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা এই যে, আমি নিজেকে জোর করে কোথাও উপস্থাপিত করতে পারি না এবং প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারি না। যেখানে প্রত্যাখ্যানের সম্ভাবনা থাকে সেখানে কিছু চাই না, সেখানে যাই না, সেখান থেকে সরে আসি’।
পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগে একের পর এক জীবনবৃত্তান্ত দেওয়া হলো, কিন্তু কোন সুফল এলোনা। তার মানেই প্রত্যাখ্যাত হলো। আসলে প্রত্যাখ্যান সবসময়ই বোঝায়, তুমি অযোগ্য, তুমি ব্যর্থ। সেই অনুভূতিটাই মনের সকল শান্তি কেড়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ডরহমে অবস্থিত ডিউক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. মার্ক লিয়েরি প্রত্যাখ্যানের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে দেখেছেন, প্রত্যাখ্যান একজন ব্যক্তির উৎসাহ-উদ্দীপনাকে কতটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফের নতুন করে শুরু করার বিষয়টি থমকে যায়। তাহলেই বুঝুন প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা কতটা তীব্র। তবে তিনি এটিও মনে করেন, প্রত্যাখ্যান জীবনে নানা রূপে আসতে পারে, সবটুকু প্রচেষ্টা এবং শ্রম দেওয়ার পরও। তাই কেউ হতাশ হয়ে ভেঙে পড়ে ব্যর্থতায় বুঁদ হয়ে থাকলে, সেটা কোনো সমাধান নয়। বরং যতবার আঘাত আসবে ততবার মেনে নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোটাই টিকে থাকার অন্যতম কৌশল জীবনযুদ্ধে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনলাইনের যুগে প্রত্যাখ্যানের পরিসীমা যেন আরও ছড়িয়ে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কাউকে হঠাৎ করে ব্লক করলে, আনফ্রেন্ড করলে এমনকি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট না করে ইগনোর করলে তাও একধরনের প্রত্যাখ্যান। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় প্রেমের প্রত্যাখ্যান। এর যন্ত্রণা বড়ই কষ্টদায়ক, যা তিলে তিলে দগ্ধ করে। এক্ষেত্রে সময়ের চেয়ে বড়ো শুশ্রƒষাকারী আর কেউ নেই।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ব্রানসন বলেছেন, ব্যর্থতা আর প্রত্যাখ্যান দুটোই জীবনের অংশ। এই ব্যর্থতা আর প্রত্যাখ্যানই শিক্ষা দেবে কিভাবে সাফল্যের দরজা খুলে যাবে। তাই সাহসিকতার সাথে প্রত্যাখ্যানকে আলিঙ্গন করাই শ্রেয়। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কারনে মানব জাতি আজ এত উন্নত। বর্তমানে মানুষ প্রত্যাখ্যানকে সহজভাবে নিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সমাজে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রত্যাখ্যান উদযাপনের চর্চা শুরু করেছে। প্রত্যাখ্যানও যে আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করা যায়, সে ধারণাটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁতের শাড়ি পরা, কপালে টিপ ও মাঝ বরাবর সিঁথি করা লম্বাটে গড়নের এক অপূর্ব সুন্দরী রমণী। যার রুপের জাদুতে মুগ্ধ আপামর বাঙালি। তিনি নেই, কিন্তু তবু আছেন। অভিনয় দিয়েই বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন বছরের পর বছর। বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা ষোড়শী সুচিত্রা সেন একসময় কলকাতায় পাড়ি জমান। টালিগঞ্জে নায়িকা হতে তার বেশি সময় লাগেনি।
প্রথম দিকে ইন্ডাস্ট্রির এক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তিনি সুচিত্রা সেনকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, নেতিবাচক মন্তব্যও করেন। বলেন, দেখব রমা কি করে নায়িকা হয়! আর যদি হয় তাহলে আমার হাতের তালু থেকে বটগাছ গজাবে। কিন্তু আজীবন মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার যোগ্যতা যার রয়েছে তাকে কী দমিয়ে রাখা সম্ভব? না, সম্ভব হয়নি। তারকা হওয়ার পর একদিন হঠাৎ করেই সেই পরিচালকের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের দেখা। তখন সুচিত্রা সেন বলেই বসলেন, দেখিতো, দেখিতো আপনার হাতটা যেখানে বটগাছ গজানোর কথা ছিল? গজিয়েছে কি না! আমি তো হিরোইন হয়ে গেছি ! সুচিত্রা সেন এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নন। স্বয়ং বিধাতা যাকে স্বপ্নের রানী বানিয়ে রেখেছেন, তিনি পিছু হটতে পারেন?
আরেকটি ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। একবার রাজকাপুর, যিনি বলিউডের অন্যতম স্তম্ভ, সুচিত্রা সেনকে নিজের ছবিতে নায়িকার চরিত্রের প্রস্তাব দিতে নিজে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়ি। সেই সাক্ষাৎকারেই ঘটে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। কথার মাঝে রাজকাপুর হঠাৎ করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে সুচিত্রা সেনের পায়ের কাছে বসে পড়েন। এই আচরণে বিরক্ত হন সুচিত্রা সেন এবং মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে সাফ জানিয়ে দেন তিনি রাজকাপুরের ছবিতে কাজ করবেন না। বলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রীরা যেখানে রাজ কাপুরের সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন, সেখানে সুচিত্রা সেন খুব সহজেই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সুচিত্রা সেনের এই সিদ্ধান্ত তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্বেরই প্রমাণ।
চলচ্চিত্রের মহানায়িকা এভাবেই মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নেন। এজন্যই ভারতীয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘প্রত্যাখ্যান জীবনকে দুমড়ে মুচড়ে দিতেই পারে। কিন্তু আমরা কেন দুমড়ে মুচড়ে যাব’? বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা যেন প্রত্যাখ্যানকে হাসিমুখে জয় করে নেন। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন অনন্য উচ্চতায়।
লেখক : চেয়ারপার্সন, ব্যুরো বাংলাদেশ