
আমাদের বাঁচতে দিন। কারও কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস, ক্যান্সার কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছেন স্বজনরা। নিজেও সুস্থ নই। ক্যান্সারে মারা গেছেন চাচা। ভাইটাও আক্রান্ত ক্যান্সারে। বাড়ির পাশের শিশুটিও জটিল সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর জানানো হলো তার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। আসলে রোগবালাই পেয়ে বসেছে আমাদের। মানুষ মারা যাচ্ছে অকালে। বিষ খেলে মানুষ তো মরবেই। বেঁচে থাকার তাগিদেই প্রতিদিনই আমরা খাবার খাই। কিন্তু এই খাবারই যে আবার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, সে খেয়াল রাখেন কজনে।
আমরা আসলে কী খাচ্ছি?- কখনো কি জানতে চেয়েছি? সম্প্রতি এক লেখায় পড়েছি, ‘আমরা প্রতিজনে; প্রতিক্ষণে; জেনেশুনে করছি বিষ পান।’ আরেক লেখক লিখেছেন, ‘কত কিছু খাই ভস্ম আর ছাই।’ সেদিন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল- ‘মাছের বাজারে মাছই নেই!’ প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি, তাতে কোন্্ মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা কেউই মানে না। এই বিষই আমাদের তিলে তিলে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। হাসপাতালগুলোতে গেলেই বোঝা যায় কত প্রকার রোগই না এখন মানবদেহে বাসা বেঁধেছে।
ভেজাল নেই কোথায়? ভেজালের রাজ্যে আমরা সবাই যেন রাজা। ভেজাল দিচ্ছি; ভেজাল খাচ্ছি, ভেজাল বলছি; ভেজাল করছি। এটা তো দেখছি ভেজালের এক মহারাজত্ব। কেউ কেউ বলেন, এদেশে কেবল খাদ্যে নয়; বিষেও নাকি ভেজাল আছে। কথা কিন্তু মিথ্যে নয়। ভেজাল খেয়ে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কিডনি নষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে হাই প্রেশার; দুরারোগ্য ক্যান্সার ও হার্টস্ট্রোকে অহরহ মরছে মানুষ। প্রতিটি খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষ। সেই বিষ খেয়ে আমরা কেউ সুস্থ থেকেও বেঁচে নেই। জীবিত থেকেও যেন লাশ হয়ে গেছি। এ যেন জিন্দা লাশ! রোগে শোকে কয়েকটা দিন বেঁচে থাকা এই আর কি! প্রতিনিয়তই বিষ খাচ্ছি খাদ্যের মাধ্যমে।
আসলে আমরা জেনেশুনেই বিষ খাচ্ছি। না খেয়ে উপায়ই বা কী? তবে উপায় একটা আছে। না খেয়ে থাকলে এ থেকে যেন নিস্তার মিলবে। কিন্তু তাতো হওয়ার নয়। তাই আমে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা আমরা কিনে নিচ্ছি। সেই বিষ মেশানো খাবারই সপরিবারে গিলে খাচ্ছি দিন-রাত। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা পানীয় দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে এবং তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও বা তদ্রƒপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং তদুপরি জরিমানাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে অর্ধশত বছরের পুরানো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীনে নিষিদ্ধ, এরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এজন্য আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। বাস্তবে সেই বিধান মানছে কজন।
বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে। পালনীয় বিধানাবলী ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই কেন? এটা বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।
খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে না- এটাই বিধান। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছে না। এ জন্য চলমান ভেজালবিরোধী আইনকে কঠোর করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ‘দি পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স’ ১৯৫৯ বর্তমান ব্যবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইন যখন হয়েছে তখন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক দ্রব্য সৃষ্টিই হয়নি। তদুপরি খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে আশির দশকের পর। ফলে, জনস্বার্থে আইন সংশোধন না করে নতুন করে কঠোর আইন তৈরি করতে হবে। এতে খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ২০২ ধারা অনুসরণ করা দরকার। কারণ, খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষ মারা এবং সরাসরি মানুষ মারাকে এই অপরাধের আওতায় আনা না হলে ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। এভাবে খাদ্যে ভেজাল চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থেই সরকারকে কঠোর হতে হবে। অপরদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। বিএসটিআইর জন্য ‘ইকুইপমেন্ট ক্রয় ও ধারাবাহিকভাবে দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা দরকার। পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ সংশোধন করা হয় ২০০৫ সালে। আইনটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ছিল না। এ আইন স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করত। মূল ভূমিকা পালন করত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এসব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজের সমন্বয়হীনতায় ভেজাল রোধ করা সম্ভব হয়নি। এত আইন রয়েছে ও হয়েছে, তবু কেন ভেজাল থেমে নেই? খাদ্যে ভেজালের অপরাধে দেশে কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। এ অবস্থাই ভেজালকারীদের উৎসাহিত করছে। আর এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন হলো, ভেজালের বিরুদ্ধে আমরা কি সোচ্চার? হলে কতটা? জীবন বাঁচানোর তাগিদেই তো যুদ্ধে নামা দরকার। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই।
এ অবস্থায় সর্বতোভাবে তৎপর হতে হবে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এতে গণমাধ্যমেরও ব্যাপক ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। সর্বোপরি ভেজাল প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত দরকার। গ্রামেগঞ্জে, শহরে-নগরে এ বিষয়ে প্রয়োজনে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একযোগে আওয়াজ তুলতে হবে- ‘আমরা আর ভেজাল খাব না; ফরমালিনমুক্ত খাবার চাই।’ মানুষ তো বাঁচার জন্য খায়, মরার জন্য নয়। আর খাদ্য যদি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা মর্মান্তিক অবশ্যই। বিষয়টি নিশ্চয়ই সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন।
লেখক : সাংবাদিক
www.mirabdulalim.com