ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১

বিশ্ব মানবতা আজ কোথায়

ড. মো.শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ১২ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্ব মানবতা আজ কোথায়

আগামী জুনে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে জাতিসংঘের সম্মেলন হবে, যা খুবই ইতিবাচক। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেন, তাদের লক্ষ্য হলো জুনে সৌদি আরবের সঙ্গে যৌথভাবে এ সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায় করা। কিন্তু হাজার হাজার নিরীহ শিশু-নারী ও ফিলিস্তিন ইসরাইলি বাহিনীর অত্যাচারে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে, যা খুবই মর্মান্তিক। তাই বিশ্ব নেতাদের অনুরোধ করব এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন অবিলম্বে। তা হবে এই মুহূর্তে জরুরি পদক্ষেপ। আর দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকা থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার যে কোনো প্রচেষ্টাকে কঠোর ভাষায় নাকচ করেছেন সৌদি আরব। বিশ্বে যারা মানবাধিকার নিয়ে যারা কথা বলে, তাদের সবাইকে একই সুরে এখন প্রতিবাদ করা বা ইসরাইলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যে কোনো অজুহাতেই হোক না কেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের প্রস্তাব সকল আরব দেশসহ অন্যান্য যে কোনো দেশের উচিত প্রত্যাখ্যান করা। ইসরাইল এই স্থানান্তরকে ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ বলে উপস্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার প্রতিবাদ বাংলাদেশ সরকারকেও জানানো উচিত। যেখানে ফিলিস্তিনিরা জীবনধারণের মৌলিক সুবিধা বা অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেখানে ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ শব্দটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর জন্য ওআইসির কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে আসছে ইসরাইল। দেশটির এ হামলায় ৫০ হাজার ৮০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। কেউ কেউ বলছে এই সংখ্যা আশি হাজার বা লাখের কাছাকাছি হতে পারে, যার মধ্যে অন্তত ১৭ হাজার শিশু। বিশ্বে যারা মানবাধিকারের সংজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে, আজ তারা কোথায়। আজ তাদের পরোক্ষ নির্দেশেই ফিলিস্তিনের নিরীহ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আজ এক অমানবিক বিশ্বে আমরা বসবাস করছি।
ইসরাইল নানা সময়ে যুদ্ধ বিরতিতেও ফিলিস্তিনের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ইসরাইল বারবার শান্তি আলোচনার দোহাই দিয়ে বিশ্বকে মূল ঘটনা থেকে আড়ালে রেখেছে। অথচ অর্ধশতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, অবমাননা ও হিংস্রতার মধ্য দিয়ে একেকটি দিন অতিবাহিত করছেন। হামাসের রকেট হামলার দোহাই দিয়ে সংঘবদ্ধভাবে নিয়মিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানো হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর, যা রকেট আক্রমণের চেয়েও বহুগুণে ভয়ংকর। ফিলিস্তিনে কি ঘটছে এবং কি ঘটতে যাচ্ছে, তা আমাদের হতবাক করে। ফিলিস্তিনে এসব হামলার ঘটনা কি চরম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়? বিশ্বে এখন মানবিকতা কোথায়? ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব নেতারা কি করছেন? এই সংকট মোকাবিলায় কেন ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাই আমরা। শুধু নিন্দা জানিয়ে এই অন্যায় হামলার স্বরূপ বোঝানো যাবে না। ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু যারা এই কাজটি করবে বলে আমরা আশা করি, সেই পাশ্চাত্য দেশগুলো ইতোমধ্যে এই হামলার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন জুগিয়ে চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুখে যুদ্ধবিরতির পক্ষে সমর্থন জানালেও ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। ঈদুল ফিতরের দিনও গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় শিশুসহ কমপক্ষে ৬৪ জন নিহত হয়েছে। শিশুদের কান্নার আহাজারি দেখেও কি বিশ্ব নেতাদের মনে হয় না যে, এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার? আর কত প্রাণহানি হলে বিশ্ব নেতাদের এবং জাতিসংঘের ঘুম ভাঙবে? ফিলিস্তিনে টানা বিমান হামলা ও বোমা বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। নির্বিচারে হত্যা করছে নারী, শিশুসহ বেসামরিক লোকজনকে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে গোটা গাজা নগরীকে। উগ্র ইহুদিদের আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি দাতব্য কার্যক্রম, মিডিয়া কার্যালয়, আবাসিক ভবন। এমনকি স্কুল ও হাসপাতালেও টানা বিমান হামলা চালিয়েছে তারা। হত্যাযজ্ঞে মত্ত ইসরাইল গাজায় অবস্থিত কাতারের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যালয়েও হামলা চালিয়েছে। বিমান হামলা থেকে রক্ষা পায়নি চিকিৎসা সেন্টারও। এতে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক হাসপাতালের কার্যক্রম। এ আগ্রাসনকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা প্রয়োজন। ইসরাইলের এসব বিমান হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন আইনজ্ঞরা। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আরদি ইমসেইস বলেছেন, গাজা উপত্যকার অসমর্থিত বাহিনীর মোকাবিলায় ইসরাইল যা করছে, তা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ। তিনি বলেন, ইসরাইল প্রাথমিকভাবে স্বাতন্ত্র্য, আনুপাতিকতা ও সতর্কতার নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে যুদ্ধাপরাধ করছে, তা বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে। এ রকম যুদ্ধবিগ্রহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকলে বিপন্ন হয়ে পড়বে মানবতা। ইতোমধ্যে যে বিপুল সংখ্যক শিশু মারা গেছে তাতে প্রমাণিত যে, এদের মনে মানবতার লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। তাই এখনই উচিত হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে  শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বেছে নেওয়া। আক্রমণ নয়, পাল্টা আক্রমণ নয়, বিশ্বনেতা ও রাজনীতিবিদদের উচিত দুই জাতির এ বিবাদের সঠিক ও স্থায়ী মীমাংসা করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ বৈশ্বিক।
ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজায় হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় বিশ লাখ মানুষ। কি ভয়ানক অবস্থা! জাতিসংঘ এসব বিষয়ে অবগত। তাহলে তারা কেন এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। সংগঠনটি কিসের জন্য তৈরি করা হয়েছে? এ ধরনের সংগঠনের কোনো প্রয়োজন আছে কিনা সেই প্রশ্ন জাগে মনে। প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য গাজা উপত্যকা চরম মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে যাবতীয় ত্রাণ কার্যক্রম। এসব তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, ফিলিস্তিনিরা কি চরম বিপর্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। কতটা অমানবিক সমাজ হলে এটা করতে পারে! বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক স্থানে ইসরাইলবিরোধী মানববন্ধন ও তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদ হওয়া একান্ত প্রয়োজনও ছিল। মানুষ তো মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ধর্ম তো কোনো পরিচয় না, পরিচয় হলো মানুষ। বিশ্বের সবাই মানুষ, সবাইকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। সবাই সোচ্চার হলে পৃথিবী থেকে এ ধরনের অন্যায়, অত্যাচার বন্ধ হবে। অন্যথায় এ ধরনের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড চলতেই থাকবে।
জাতিসংঘের উচিত ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং অবিলম্বে এ ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করা। যদিও জাতিসংঘ এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অনেক মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে, যা দুঃখজনক। তাদের বলতে চাই, এ অন্যায়ের পথ থেকে সরে আসুন, নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করুন। যাতে মুসলমানরা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে। উগ্র ইহুদি আগ্রাসন থেকে বাঁচার উপায় সন্ধান করুন। শুধু হামলাকারী ইসরাইল নয়, যারা এ হামলায় সমর্থন দেয়, তাদের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হওয়া উচিত। তাই জাতিসংঘের উচিত হবে অন্যান্য দেশ থেকে ফিলিস্তিনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। কিছু বিদেশী সংবাদমাধ্যম তাদের পেশাদারিত্ব মানছে না। তারা তাদের মিডিয়াতে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরছে না। বরং অন্য কথা লিখছে। ফিলিস্তিনিদের যে কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদকে কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে থাকে। যদিও এ রীতি অনেক পুরানো। তারা কোনো সভা বা সমাবেশ করলে এটাকে বলা হয় সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর সম্মেলন। তাদের ভূখণ্ডে ইসরাইলিরা আবাসন ভবন তৈরি করতে গেল, জমি দখল করতে গেল, এতে কোনো সমস্যা নেই এবং বিশ্ব মিডিয়াতে তা প্রকাশ পায় না। বরং ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ করলে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এতে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিচার থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যায়। ফিলিস্তিনের জাতিগত মুক্তি সংগ্রামকে ইসলামের সঙ্গে মিলিয়ে না ফেলে ফিলিস্তিনিদের শুধু ‘মুসলমান’ হিসেবে না দেখে, তাদের মানুষ ভেবে নিরীহ শিশু ও নারী হত্যা এবং গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়া উচিত। বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হোক। বিশ্ব নেতাদের মাঝে সুবুদ্ধি, শুভ চিন্তার উন্মেষ হোকÑ এ প্রত্যাশা করি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×